সাজিয়া আফরিন স্বপ্না
শ্রাবণের প্রথম দিন আজ। রাত থেকেই বিরামহীন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির দিনের সব সুখের স্মৃতি ঢাকা পড়ে গেছে একটা স্মৃতির অন্তরালে। একটা স্মৃতি নিমেষেই যেন সব মধুর স্মৃতি লোপাট করে দিয়েছে। সেদিন থেকে শুধুই ধূসর একটা মাকে দেখেছি।
মাকে শেষ দেখেছি উঠোনের কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে। তারপর থেকে আর কখনও তিনি প্রকাশ্যে কাঁদেননি। সবার চোখের আড়ালে বন্ধ দরজার ওপাশে মা যে রাতের পর রাত কেঁদে পার করেছেন তা আমি জানি। সেদিন ভোররাতে বাবার বুকব্যাথা করছিল। হাসপাতালে নেয়ার পরে ডাক্তার বাবার হাতটা ধরেই মৃত ঘোষণা করলেন। খবর শুনেই মা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে, বাবা আর বেঁচে নেই।
সেদিনও ছিল শ্রাবণের প্রথমদিন। সকাল থেকেই আকাশটা গুমোট ধরে আছে। কখন যেন পিপাসা মিটিয়ে বৃষ্টি নেমে আসবে। বারান্দায় বাবার লাশ রাখা হয়েছে কয়েক ঘন্টা ধরে। মা বাবার মাথার পাশে ঠায় বসে রইলেন। তার চোখে কোনো জল নেই কিন্তু চোখ জুড়ে ছিল সীমাহীন শূন্যতা। আত্মীয় স্বজন সবাই এলো বাবাকে দেখতে। মা কারও সাথে একটাও কথা বললেন না। চাচী খালারা অনেক চেষ্টা করলেন মা যেন একটু কাঁদেন। কিন্তু মা মূর্তির মতো বসে রইলেন। বাবাকে খাটিয়াতে উঠানোর পরে মা হঠাৎ চেতনা ফিরে পেলেন। চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এই তোরা আমার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?”
মায়ের এমন পাহাড় সমান ভারী প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা কারও নেই। চাচী আর খালা মায়ের দুই হাত টেনে ধরলেন। মা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। কিন্তু চিৎকার করেই চলেছেন, “কেউ ওকে ছুঁবি না!” আমি খাটিয়া কাঁধে নিয়ে শেষবার মায়ের দিকে তাকালাম। করুণ আকুতি ভরা সেই চোখের পানে তাকিয়ে থাকার সাহস পেলাম না। লাশ নিয়ে বাড়ির আঙিনা পার হতেই মায়ের বিকট চিৎকার কানে এলো, “আমায় রেখে যেও না! আমি একা থাকতে পারব না!”
পিতার লাশ কাঁধে নিয়ে হাঁটছি আর কানে বাজছে মায়ের আর্তনাদ। কেমন করে কবরস্থানে পৌঁছেছিলাম তা সত্যিই জানি না।
বাবাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে কাফন খুলে তার মুখটা বের করা হলো, তখন আমার আকাশ মাটি এক হয়ে গেল। বাবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। একটু পরেই উঠে আমার হাত ধরে বাজারে যাবেন। তারপর বলবেন,
“যে ইলিশটা তোর পছন্দ সেটাই কিনব।”
আমি হাতের ইশারায় ডিমওয়ালা একটা ইলিশ দেখিয়ে দেবো। বাবা দামদর না করে সেটাই কিনে নিয়ে আমার হাত ধরে বাড়ি ফিরবেন। ইলিশের ডিম আমাদের দু’জনারই খুব পছন্দ। বাবা সবটুকু ডিম আমার প্লেটে উঠিয়ে দিয়ে বলবেন,
“খা বাপ, মন ভরে খা!”
কবরে শুয়ে থাকা ঘুমে আচ্ছন্ন পিতার দিকে তাকিয়ে অতীতে ডুবে গিয়েছিল সেদিন। চাচা আমার হাত ধরে টেনে কবর থেকে উঠিয়ে নিলেন। কবরের উপরে বাঁশের টুকরা একটা একটা করে রাখল আর ঢেকে গেল আমার বাবা। মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো বাঁশের খাপাচিসহ আমার বাবাকে। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। পুরুষ নামের এই শক্ত প্রাণীদের চোখের জল খুব দামি হয়। তাই তো এরা কাঁদে না সহজে। কিন্তু পিতৃ বিয়োগের এই অকাল বোধনে আমার চোখের প্লাবণ বাঁধ ছেড়ে দিলো। কবরে পড়ে থেকে “বাবা” “বাবা” বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদলাম। গুমোট ধরে থাকা মেঘ আমার কান্নায় সামিল হলো। চোখের প্লাবণ ঢাকতে শ্রাবণ নেমে এলো আকাশের বুক চিরে। অঝরে ঝরা বৃষ্টি ঢেকে দিলো আমার চোখের জল। কিন্তু বুকের ভেতরের পিতৃ শূন্যতার হাহাকার আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল। খুব ইচ্ছে করছিল, কবরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি, “বাবা তোমায় না দেখে বাঁচব কী করে? জীবনের কঠিন সময়ে ছায়া হয়ে কে থাকবে আমার পাশে? কে খুব যত্নে আমার বুকের ব্যাথা উপলব্ধি করে আমাকে সান্ত্বনা দেবে? ফিরে এসো বাবা! আর একটিবার ফিরে এসো!”
বাড়ির আঙিনায় পা দেবার আগেই মায়ের কান্নার শব্দ কানে এলো। উঠোনে ঢুকেই জীবনের সেরা হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখলাম, মা কাটা মুরগির মতো উঠোনে পড়ে ছটফট করে কাঁদছেন। কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে মায়ের সারা শরীর। বৃষ্টি কাদা ধুয়ে দিচ্ছে কিন্তু তার ছটফটানিতে আবার কাদা লেগে যাচ্ছে। চাচী খালারা মায়ের পাশে নির্বাক বসে বৃষ্টিতে ভিজছেন। স্বামী হারানোর শোকে আর্তনাদে উন্মাদ হয়ে যাওয়া এই মানুষটাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা কারও নেই।
ধূসর হয়ে গেলেন আমার মা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি বরণ করে নিলেন সাদা শাড়ি। সারা শরীরে কোনো গহনার চিহ্ন নেই। স্বামীর শোকটাকে তিনি ভেতর বাহির সবখানেই ধারণ করেছেন। এগারোটা বছর ধরে রোজ ফজরের নামাজ পড়ে বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ভুল হয়নি কখনও তার। কিন্তু বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে মা সেখানে যান না অজানা কারণে। আজ সকালে মা দরজা খোলেননি। বিগত এগারো বছর ধরে এই দিনে তিনি দরজা বন্ধ করে থাকেন। কিছুতেই আমার সামনে আসেন না। প্রথম বছরে আমি অনেক দরজা ধাক্কিয়েছি কিন্তু মা দরজা খোলেননি। আস্তে করে শুধু বলেছেন, “আমায় একা থাকতে দে।”
তারপর, প্রতি বছরে একই ঘটনা দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রতি বছরের মতো আজকেও আমি একাই এসে দাঁড়িয়েছি বাবার কবরের পাশে। বাবার কবরে দাঁড়িয়ে থাকা মালতী ফুলগাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। গাছটা এগারো বছর আগে আমিই লাগিয়েছিলাম। গাছটাও বুড়িয়ে গেছে, এগারো বছর আগে এগারো বছর বয়সে যতটা পিতৃশূন্যতা অনুভব করেছি, আজ তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি অনুভব করি।
আস্তে করে বললাম,
“কেমন আছো বাবা? আমাকে কী একটুও মনে পড়ে না?”
বরাবরের মতো আজকেও আমার ভেতর থেকে জবাব এলো, “ভুলিনি তোকে বাপ।”
সন্তানের সাথে মায়ের থাকে নাড়ির টান আর বাবার সাথে লুকিয়ে থাকে সন্তানের হৃদয়ের টান। ঠিক যেন হৃদয়ের যোগসূত্র। বাবা তোমাকে বড্ড অনুভব করছি, ফিরে এসো বাবা!
বনপাড়া, নাটোর।