অমিত মজুমদার
রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মেসেঞ্জারে মেসেজটা ঢুকলো। “শুভ স্বাধীনতা দিবস”। মেসেজটা বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছে মোহিনী চৌধুরী। মোহিনীর সঙ্গে পরিচয় ফেসবুকে। সে ওখানে একটা নামকরা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। বেশ পরিচিত মঞ্চ অভিনেত্রী। আমি যদিও নাটক বা কোনো শিল্পের সঙ্গেই সঙ্গে যুক্ত নই তা সত্ত্বেও যোগাযোগটা হয়েছে। যোগাযোগটাও বেশ চিত্তাকর্ষক। সে কখনও এপারে আসেনি আমিও তেমন কখনও ওপারে যাইনি৷ বেশ কয়েকজন ফেসবুক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে আমাকে সে খুঁজে পায়। এই খোঁজার জন্য অনেক সময় লেগেছে তার। আমি কোনো বিখ্যাত লোক নই তবু সে আমাকে খুঁজে নিজে থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তারপর পরিচয়। অনেক কথার আদানপ্রদান। অনেকটা চেনাজানা।
মেসেজের রিপ্লাই দিতে যাচ্ছিলাম, আপ্লুত হলাম। আমাদের দেশের তরফ থেকে আপনার অভিনন্দন গ্রহণ করলাম। কিন্তু গোটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করা কি খুব বড় একটা ধৃষ্টতা নয় ? মোহিনী চৌধুরী হয়তো অনেককেই এমন একই মেসেজ করেছে। সবাই এই দেশের প্রতিনিধি। তাই খুব ছোটো করে লিখলাম, “ভীষণ ভালো লাগলো। খুব আনন্দ পেলাম। আপনিও শুভেচ্ছা নেবেন।” লিখেই মনে হলো এই দিনটা মোহিনীরও স্বাধীনতা দিবস হতে পারতো। ওর দাদুর বাস ছিলো হাওড়ার একটা গ্রামে। দেশ ভাগ হবার পর তিনি বাড়ি জমি সব বিক্রি করে পরিবার সহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। আবার আজকের দিনটা আমার কাছেও স্বাধীনতা দিবস নাও হতে পারতো যদি না আমার দাদু দেশভাগের পর একইভাবে ঢাকা ছেড়ে চলে আসতেন। আমাদের পুর্বপুরুষেরা দেশ বদল করেছেন। আমরা এখন সেই বদলানো দেশের প্রতিনিধি।
মেসেজ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো, “আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে এই সময় আপনাদের দেশে স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা উঠেছিলো। সারা দেশে তখন স্বাধীন হবার আনন্দ। সেটা তখন আমার দাদুরও দেশ ছিলো। সেই দিনের আনন্দ তিনি উপভোগ করেছিলেন। রাত বারোটার পর সারা উঠোন আলোকিত করতে তিনি উঠোন জুড়ে প্রচুর প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। প্রতিটা প্রদীপ মাটি দিয়ে নিজের হাতে তৈরী করা।”
এবার কি আমার বলা উচিৎ, আমার দাদু সেটা উপভোগ করতে পারেননি। তিনি ওই মুহূর্ত থেকেই একই মাটিতে থেকেও অন্য একটা দেশের বাসিন্দা হয়ে যান। জল, মাটি, পাখির ডাক সব এক ছিলো শুধু দেশের নাম বদলে যায়। এটাও বলতে পারলাম না। বললাম, “আজ আপনাদেরও একটা শোকের দিন৷ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন।”
মোহিনী কিছু লিখলো না। শুধু একটা কান্নার ইমোজি পাঠালো। আমি আবার মেসেজ করলাম, “দিনটা আমাদের দুই দেশের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজ এক দেশে আনন্দ আর এক দেশে বেদনার ছায়া। আর এই আনন্দ বেদনা দুটোই দুই দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত।”
আর কোনো রিপ্লাই এলো না। মেসেজ সিনও হলো না। সম্ভবত মোহিনী অফ হয়ে গেলো এইমাত্র৷ রাত সাড়ে বারোটা পার হয়ে গেছে। আমি বিছানা উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বাইরে এলাম। আমার সামনে উঠোন। এই উঠোনেই পঁচাত্তর বছর আগে আজকের দিনে মোহিনীর দাদু প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। বাড়িটার অনেক পরিবর্তন হলেও উঠোনটা সেই আগের মতোই আছে।
নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।