বিদেহীর কথা
একটা অন্ধকার টানেল গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে…তো ….নামছেই, কোথাও কোনো আলোকবর্তিকা নেই। এত অন্ধকার কি দিয়ে সৃষ্টি হয়! অপার্থিব কালো রং কেউ ঢেলে দিচ্ছে গড়ানো পিছল পথে। কিন্তু একি! ওই গলানো কুৎসিত কালো রংয়ে যে ডুবে যাচ্ছে পায়ের পাতা , গোড়ালি, হাঁটু, কটিসন্ধি ! অজান্তেই সেই মসি রং হাতে মেখে চোখের সামনে আনতেই গা- গোলানো রক্তগন্ধে বমি উঠে আসে। তলপেটে তীব্র বর্শা ফলক ঢুকে যাওয়ার যন্ত্রনার বোবা শিৎকার ঘুরে বেড়ায় তন্ত্রী থেকে তন্ত্রীতে। প্রানপণ শক্তিতে দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরতে চায় কোনো ময়দানবের কন্ঠনালী , কিন্তু হাত পিছলে যায়। পরাজয়ে, ক্লান্তিতে দুচোখ জুড়ে কালঘুম নেমে আসে৷ কয়েক যুগ পর আচম্বিতে সেই কদর্য অন্ধকারের পৃথিবীতে শত ভোল্টের আলো ঝলসে ওঠে ! তীব্র আলোর শাণিত ফলার ক্রূর আতঙ্কে প্রানপনে চিৎকার করতে গিয়ে তালুর সাথে জিভের স্পর্শ খুঁজে পায়না ! গলা থেকে একদলা শ্লেষ্মা দাঁতের প্রান্তসীমায় জমা হয়। সুতীব্র আশ্লেষে নোনা স্বাদ পাওয়ার চেষ্টা বৃথা হয়ে যায়। তীব্র আকুতি ছড়িয়ে পড়ে চোখ- মুখ-কর্ণ-নাভিমূল জুড়ে। ঘর্ঘর শব্দের মধ্যে অজস্র কথা চালাচালির ঘামগন্ধে আবার তলিয়ে যায় সব চেতনা। সারা আকাশ ছাপিয়ে আলকাতরা রং বিন্দু বিন্দু ঢেকে দেয় বাহ্যিক চেতনা।
অধিরথের কথা:
হলুদ ছোপানো নদীটার কথা বড় মনে পড়ে ! যার একপারে এক হরিণীর সংসার। ভোরবেলা ছেলে হরিণটি শিকারে বেরোয়, আর মেয়ে হরিণ তার গোলাপী রঙা শিশু হরিণের গা পরম মমতায় চেটে দেয়। জোর করে মুখটা গুঁজে দেয় উন্মুখ স্তনবৃন্তে। আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখে, শিয়াল, হায়না, চিতার লোলুপ ঠোঁট চাটা দেখতে দেখতে এই জঙ্গলে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। ছেলে হরিণ শান্তি চোখে দেখে, মেয়ে হরিণের শরীরটা গ্যাস দেওয়া বেলুনের মতো ফুলতে ফুলতে ঢেকে দেয় ছোট্ট শিশুটির এক চিলতে কাঠামো। বৃন্তমুখে স্বর্গসুখ খেলে যায় অধর মুখখানি জুড়ে ৷ পরম নিরাপত্তায় চোখ বুজে আসে স্বর্ণ শাবকের। তৃপ্ত ও আশ্বস্ত হয়ে শিকারের সন্ধানে বের হয়ে যায় ছেলে হরিণটি। প্রকৃতির নিবিড় পরিচর্যায় দিনে দিনে এক চিলতে মাংস পিন্ডটি বড় হয়, হেঁসে-খেলে-নেচে-গেয়ে নিজের একটা পৃথিবী তৈরি করে। মেয়ে হরিণটির আদর খায়, ছেলে হরিণটির কাছে বায়না করে, আর তাদের ভয়, উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে হঠাৎ হঠাৎ নিজের পৃথিবীতে হারিয়ে যায়। এটাই জঙ্গলের দস্তুর। সবাইকে নিজ নিজ পৃথিবী চিনে নিতে হয়। তবু ভয়ে বুক কাঁপে, ও যে বড় ছোট, বড় অবুঝ ! ছেলে আর মেয়ে হরিণের দিন কাটে, রাত কাটে ওই একচিলতেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। অপরিসর আস্তানায় মেয়ে হরিণের বুকে মাথা আর ছেলে হরিণের পেটে পা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে একরত্তিটা। একদিন পৃথিবীটা একই থাকে, মহাকালের নিয়মে সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, শুধু ছেলে আর মেয়ে হরিণের জন্যে পড়ে থাকে এক দলা মাংস আর এক সমুদ্র রক্ত।
পাঞ্চালীর কথা
সময় কখন থেমে গেছে টের পাইনি। সকাল থেকে কানের মধ্যে অজস্র পতনের শব্দ। সবকিছু ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ভূমিকম্প দেখিনি কখনো, তখনও কি এভাবে কানের মধ্যে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকা আর্তনাদ করে ! আচ্ছা নদীর যখন পাড় ভাঙে, ঝড় যখন ঘর ভাঙে বা মানুষে মানুষে বিশ্বাস ভাঙে, তখনোও কি এরকম শব্দ ছড়ায় চরাচরে ! আর বুক ভাঙার শব্দ ! নিরন্তর হতে থাকা ‘লাবডুব লাবডুব’ শব্দকে পাশবিক আক্রোশে টেনে ছিঁড়ে দিতে চায়! তবে প্রতিহিংসার শব্দ বড় মধুর মনে হয়। অনাদি পশুগুলোর ধড় থেকে মুণ্ডুগুলো ছিঁড়ে নেওয়ার শব্দ নিশ্চয়ই খুব রোমান্টিক হবে ! একটা লাল রক্তরঙা হাঁসি খেলে যায় সারা মুখ জুড়ে।
বিদেহীর কথা:
অন্ধকারে পথটি এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। অপরিসর টানেলে অন্ধকারের শেষ নেই, আর পথও অন্তহীন। বড় ক্লান্তি ! সারা শরীরে কারা যেন হাজার হাজার সূঁচ ফোটাচ্ছে। আরে ওরা বুঝতে পারছেনা, এই সব ছিদ্রপথ দিয়ে ধীরে ধীরে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে ! বিদেহী চিৎকার করে বলতে চাইছে, কিন্তু টাকরার সাথে জিভের স্পর্শ ঘটাতে পারছেনা। শুধু একদলা কফ গলা পেরিয়ে দাঁতের পাটিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে সে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলো। শরীরটা নিচু করতেই কোমরের নিচ থেকে ঝরে পড়তে লাগল উষ্ণ তরল। অচিরেই ভিজে গেলো মাটি, ভেসে গেল পথ। চ্যাটচেটে ভিজে হাত অন্ধকারে চোখের সামনে তুলতেই কাঁচা রক্তের মাংস গন্ধে আবার চেতনা হারালো বিদেহী। ঘর্ঘর ঘর্ঘর শব্দটা চলতেই থাকলো, চলতেই থাকলো। কত পল, অনুপল, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেরিয়ে …..সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে হেঁটে হেঁটে হেঁটে আলোর সন্ধান পাওয়া গেলো। চিরতরে চোখ বন্ধ করার আগে কাকে যেন ‘ধন্যবাদ’ জানাতে চাইলো…কিন্তু হায় টাকরার সাথে জিভের স্পর্শ খুঁজে পেলোনা…. শুধু ঘর্ঘর শব্দে গলা থেকে উঠে আসে একদলা কফ।
…………xxx……………