ভালোবাসার গল্প – সুমন্ত আশরাফ
১
বিছানার উপর পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটা বাজতেছে। পাশে পুলক নিবিড় মনোযোগ দিয়ে অংক সমাধান করতেছে। পুলক একবার অংকে ভেতর মাথা গুঁজে দিলে দুনিয়ার কিছুই তার স্বরণে থাকে না এই তার একটা সমস্যা। এজন্য তার রিংটোনের ভলুম বেশ বাড়ানো থাকে। যার দ্বারা কল আসলে টের পায় সে।
একটা সময় ছিল যখন এই রকম একটা রিংটোনের অপেক্ষায় থাকতো পুলক। কখন বেজে উঠবে রিংটোনটা। হঠাৎই বেজে উঠলে কেমন যেন অস্থির হয়ে যেত পুলক। কিন্তু পরক্ষণই আবার নিরাশ হয়ে যেত, যখন দেখত রিংটোন বাজার কারণটা অন্য।
পুলক এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়তেছে গনিত নিয়ে। যদিও সপ্ন ছিল নামকরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়বে সে। কিন্তু আজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়তেছে। তবুও অনেক খুশিই সে। কারণ সে জানে এসব তার নিজের কিছু ভুলের জন্যই হয়েছে। অনেক কষ্ট হয়েছে নিজেকে মানিয়ে নিতে।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
খুব স্বাভাবিক ভাবে কলটা রিসিভ করলো পুলক।
ওপাশটা নিরব। শুধু একটা নিশ্বাসের শব্দ আসল। পুলক যেন মুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল। নিশ্বাসটা তার চেনা! কিন্তু কিছুতেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। একবার ফোন নম্বরটা চেক করার পর শিওর হল পুলক। এক রকম অস্পষ্ট গলায় বলল,
“কে উর্মি!”
রাত দশটা টা বেজে পনেরো মিনিট। রিফাত টিউশন হতে ফিরেছে। রিফাত আর পুলক একই রুমে থাকে। রুমে ঢুকতেই পুলকের উপর চোখ পড়ল রিফাতের। পুলক টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে আছে।
“কি রে? এভাবে আছিস যে?
শরীর খারাপ নাকি?”
পুলক চুপ।
“রাতের খাবার খেয়েছিস?”
“নাহ।”
এবার পুলক উত্তর দিল।
রিফাত রুম থেকে বের হয়ে গেল। আবার প্রায় পনেরো মিনিট পর রুমে আসলো দুই হাতে দুটো গামলা নিয়ে। পুলক আগের মতই আছে। রিফাত আবার খেতে ডাকলো তাকে।
“তুই খা দোস্ত, আমি খাবো না।”
রিফাত পাশে এসে দাড়ালো পুলকের। কপালে হাত রেখে দেখল। না জ্বর টর তো হয় নি। পাশের চৌকিটাতে বসল রিফাত।
“কি হয়েছে তোর বল তো?”
রিফাত ছাড়বার পাত্র নয়। তবুও তার মুখ থেকে আসল কারণটা বের করতে পারল না রিফাত।
কয়েকদিন পর।
পুলক বসে আছে। তার সামনে তার ছাত্র বসে অংক সমাধান করছে। তার ছাত্রের সামনে জেএসসি পরীক্ষা। মাত্র দুমাস বাকি। পুলকসহ তিনজন শিক্ষক বাসায় এসে পড়ায় তাকে। পড়ালেখায় যেন কোনরকম গাফিলতি না হয় সে ব্যাপারে অত্যন্ত সজাক তার পিতামাতা।
“স্যার এটা একটু দেখেন তো?”
পুলক ঘরের এক কোনায় তাকিয়ে আছে। শুনতে পায় নি সে।
“স্যার, এই অংকটা একটু দেখিয়ে দেন?” এবার একটু জোরে বলল কথাটা।
পুলক হকচকিয়ে উঠল। অস্থির হয়ে বলল,
“এই যে এইটা।”
পুলক চটপট করে সমাধান করে দিল অংকটা। কিন্তু তার ছাত্র একটু পর আবার বলে উঠল,
“স্যার অংকটা ভুল হয়েছে। দেখুন উত্তর মিলেনি।”
পুলক দেখে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল। আসলেই উত্তর মেলেনি।
সেদিন শরীর খারাপের অজুহাতে তারাতারি টিউশন হতে মেসে ফিরল পুলক।
আরও কয়েক সপ্তাহ গেল। রুমে রিফাত একা। রাত্রী প্রায় এগারোটা। কোথা থেকে যেন এল পুলক। তার রুমে ঢুকার পর কিসের যেন একটা গন্ধ পেল রিফাত। খুব অবাক হয়ে বলল রিফাত,
“কি রে? আবার সিগারেট ধরেছিস?”
“হুম।”
“ভালো।”
পুলক চৌকির নীচে রাখা পুরোনো বইগুলোর ভেতর কি যেন খুঁজছে। রিফাত একবার ভাবল জিগ্যেস করি। কিন্তু উত্তর পাবে না জেনে আর জিগ্যেস করল না কথাটা।
“মিজান স্যারের এসাইন্টমেন্ট টা করছিস?”
পুলক না সূচল মাথা নাড়লো।
“শুনলাম তোর টিউশন টা নাকি আর নেই।”
“হুম।”
“এখন চলবি কিভাবে?”
“জানিনা।”
“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
“হুম। বল।”
“তুই যেসব করতেছিস তা কি ঠিক হচ্ছে?”
“হুম ঠিক হচ্ছে।”
“না দোস্ত ঠিক হচ্ছে না। তোর উচিত তোর নিজের জন্য ভাবা।”
“আমি আমার নিজের জন্যই ভাবছি।”
“না তুই উর্মির কথা ভেবে নিজের ক্ষতি করতেছিস। তোর উচিত তাকে এড়িয়ে যাওয়া। যে তোকে ছাড়া এতদিন সুখে ছিল, সে বাকি জীবনটাও তোকে ছাড়া থাকতে পারবে।”
“আমার যেটা উচিত মনে হচ্ছে আমি সেটাই করছি। তুই অযথা জ্ঞান দিতে আসবি না।”
“তোর কিভাবে মনে হচ্ছে এটা ঠিক হচ্ছে?”
“দেখ আমি তোর সাথে তর্কে যেতে চাইনা।”
“ভুলে যাস না উর্মি বিবাহিত। তার ২ বছরের একটা বাচ্চা পর্যন্ত আছে। তার চেয়ে বড় কথা তার স্বামী নিখোজ হয়েছে, মারা যায় নি।”
“উর্মি তার সাথে কখনো সুখে ছিল না। আর থাকবেও না।”
পুলক পুরোনো বইয়ের ভেতর থেকে একটা বইয়ের মত বের করল। না, বই না এটা তার পুরোনো একটা ডায়েরী।
“এসবে জড়াস না ভাই। বরবাদ হয়ে যাবি।”
এ কথার পর পুলক আর কোন উত্তর করল না। রিফাতের খুব খারাপ লাগছে। এই মুহুর্তে পুলকের পাশে একমাত্র সে। তার মনে হচ্ছে পুলক উল্টাপাল্টা কিছু একটা করেই বসবে। কিন্তু কি করবে সে। কিভাবে ফেরাবে তাকে।
২
আরও ক-দিন পর।
রিফাত ঘুমাচ্ছে। ৬টা টা বাজতে এখনও পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি।
রিফাতের মোবাইল ক্রমাগত বেজে চলছে। কিন্তু রিফাত টের পাচ্ছে না। বারকয়েক আরও বাজার পরে টের পেল সে। ঘড়িতে এখন ৮টা ১৫ বাজে। এমন তো কখনও হয় না। রিফাত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে অবাক হয় সে, গতকাল রাতে যে প্যান্ট পড়েছিল সেটা পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝতে পারছে রিফাত কেন এমন হয়েছে। তারাতারি চোখ মুছে পুলকের দিকে তাকায়। পুলক রুমে নেই। চৌকির নিচে তার কালো ব্যাগটাও নেই। রিফাত যেন ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারছে। পাশে থাকা ফোনটা আবার বাজতে লাগলো। অচেনা একটা নম্বর!
“হ্যালো।”
ওপাশ থেকে আচমকা একটা দুঃসংবাদ এলো।
মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ড এর সামনে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। যেখানে দুজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে। তার মধ্যে একজন হল পুলক।
সন্ধার আগেই পুলকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমপন্ন হল। রিফাত তার ব্যাগগুলো রুমে নিয়ে এসেছে। সাথে পুলকের এক চাচাও আছে। ব্যাগ দুটো খোলা হয়েছে। আরও গোজগাজ করা হচ্ছে। পুলকের সব জিনিস নিয়ে যাওয়া হবে। কলো ব্যাগটার ভিতর রাখা ডায়েরীটার উপর রিফাতের চোখ পড়ে গেল। এই ডায়েরীটাই সেদিন খুজে বের করেছিল পুলক। রিফাত ডায়েরীটার পাতা উল্টাচ্ছে। অনেক লেখা। সবগুলোই পুরোনো লেখা। অনেক আগের তারিখ বসানো আছে। শেষের দিকে এসে একটা লেখা পেল রিফাত। যেখানে তিনদিন আগের তারিখ বসানো আছে। রিফাত লেখাটা পড়তেছে,
‘তোমাকে ভালোবাসা যদি
অপরাধ হয়,
তবে সে অপরাধে আমি
বরবাদ হব।’
পঞ্চগড় সদর, পঞ্চগড়