জানালাটা খোলা ছিল

জানালাটা খোলা ছিল

তওহিদ মাহমুদ হোসেন

শব্দটা হলো ধপ্ করে, চাপা ধরণেরও। আর সাথে সাথেই বিচ্ছিরি একটা ‘ক্যাঁ…ও’ চিৎকার, বিড়ালের। এক মনে রান্না করছিল তুবা। খুব সাবধানে ডিমের খোসাটা আলগা করে সাদাটা ঢালতে হয়। হাত কাঁপলেই কুসুম গড়িয়ে ভেঙ্গে যাবে। আচমকা আওয়াজটায় তুবার বুকে ততক্ষণে ধুপধাপ হাতুড়ির বাড়ি।ঘড়িতে সাড়ে নটা বাজছে। কিন্তু বাইরে তাকালে মনে হবে মফস্বলের মধ্যরাত। একদম নিকষ অন্ধকার না হলেও ক্ষয়াটে চাঁদের আলোয় বাইরেটা প্রায়ান্ধকার। মনুষ্যসৃষ্ট আলো বলতে রাস্তার সবেধন নীলমনি স্ট্রিটল্যাম্পটার আলো। বাকিগুলো অনেক আগেই ফিউজ হয়ে গিয়েছে। কর্পোরেশনের দায় নেই ঠিক করার; মহল্লাবাসীরও নেই আগ্রহ। কয়েকটা বাড়ির জানালা চুঁইয়ে ছিটকে আসা আলোয় চারপাশের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়েছে।

মফস্বল না জায়গাটা; শহরের মধ্যেই। কিন্তু মনে হবে, সময় যেন খুব জোরে দৌড়ে যেতে যেতে এখানটায় এসে খেই হারিয়ে ফেলেছে। স্কাইস্ক্র্যাপারের যুগে পুরো একটা মহল্লায় এখনও সবচেয়ে উঁচু বাড়িটা ছতলার, এটা ভাবলেই ভুরু আপনাতেই কপালে উঠে যায়। কিন্তু এই আটত্রিশ নম্বর জুম্মন কোচোয়ান লেন সেই কপালে ওঠা ভুরুর থোড়াই কেয়ার করে। এই রাস্তায় এমনিতেই লোক চলাচল বেশ কম। কানা লেন বলে বাইরের লোকও ঢোকেটোকে না বিশেষ। যে দুচারটে শাখা বেরিয়েছে, সেগুলোও চক্রাকারে ঘুরে আবার এই জুম্মন কোচয়ান লেনেই এসে মিশেছে। তুবার বুকের ধুকপুকানি কমেছে না। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের জানালাটার দিকে তাকাচ্ছে। চুলোর ঠিক পাশেই অন্ধকার আঁটা একটা ফ্রেম রেখে রান্না করতে গেলে সবসময়ই মনে হয়, এই বুঝি গ্রিল বেয়ে কেউ উঠে এসে জানালার চৌকাঠে লম্বা লম্বা নখওয়ালা আঙ্গুলগুলো বিছিয়ে ধরবে। কিন্তু জানালা বন্ধ করেও তো রাখা যায় না। যে গরম। তুবা অবশ্য এতক্ষনে বুঝতে পেরেছে শব্দের উৎসটা কী। এ হল জানালার উল্টোদিকের আফ্রাদের ছাদ থেকে আরেকটা ইঁট খসে পড়ার শব্দ। নিশ্চয়ই এ পাড়ার হার্মদ বিড়াল বুলেট; ছাদের পাঁচিল ডিঙ্গাতে গিয়েছিল। পুরোনো রেলিংটার কোন ইঁট বুলেটের গায়ের ধাক্কায় আলগা হয়ে যাওয়া ইঁট-সিমেন্টের পলেস্তারায় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।

মিরাজ এখনও ফেরেনি। তুবা ঘড়িটা দেখল একবার – সাড়ে আটটা বাজে। ফোন করে কথা বলা যায়। কিন্তু খুব জরুরি না হলে মিরাজ বিরক্ত হবে। হয়তো এই মুহূর্তে কলিগদের সাথে আছে নয় বাসে ঘর্মাক্ত অবস্থায় ফিরছে। কিন্তু তুবার খুব ইচ্ছা করছে কারও সাথে কথা বলতে। আফ্রাকে করবে? ভাবতে ভাবতে ফোনটা হাতে তুলে নেয় ও। মাথায় তখনও ঘুরছে প্রশ্নটা – আজও দেরি করছে কেন মিরাজ?

২.

বিচির ক্লাসে গৌতম বুদ্ধও মনোযোগ ধরে রাখতে পারবেন না তো আফ্রা। ক্লাসের প্রতিটা ছেলেমেয়ে যে দড়ি ছেঁড়া ছাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠেছে, সেটা বিচির বোঝার কথা না। এখন পড়াচ্ছেন থ্রি-ডিমেনশন্যাল জিওমেট্রি। একঘেয়ে স্বরে বারবার বলে যাচ্ছেন তিনটা ডাইমেনশন কল্পনায় ধরে রাখতে। আরে, দশ সেকেন্ড কনসেন্ট্রেশানই থাকছে না তো তিন ডাইমেনশন। কি ভীষণ আজাব! বদরুদ্দিন চাকলাদারকে যে ছেলেমেয়েরা ‘বিচি’ করে নিয়েছে, তা কেবল নামের আদ্যাক্ষরের জন্যই নয় বরং ডায়াসে দাঁড়িয়ে পড়ানো সময়ে নিজের নিম্ন-মধ্যাঙ্গে অবস্থিত বিশেষ প্রত্যঙ্গ সংলগ্ন এলাকা চেতনে ও অবচেতনে অবলীলায় চুলকানোর জন্যও। এক ঘন্টার ক্লাস যখন পৌনে দুঘন্টায় শেষ হলো, তখন আফ্রার মাথায় একটাই চিন্তা – কখন বাসায় ফিরে বিছানায় লাফ দিয়ে পড়বে। ঘন্টাদুই না ঘুমালে আগামীকালের কুইজ চিত্তির। মাথায় তো কিছুই ঢোকেনি। শাহনাজের ক্লাসনোট আর সলভ করা চোথাটা ফোটোকপি করে এনেছিল দুদিন আগে। আজ এসপার-ওস্পার করতেই হবে। এই ক্লাসটেস্টটা ওর এখন এসিড টেস্ট।

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ঠিক চারটায়। জানালার বাইরে চোখ পড়তেই কেন যেন মনটা হঠাৎ খুব ভালো লাগতে শুরু করলো আফ্রার। আজ সূর্য ডোবা পর্যন্ত ছাদভ্রমণ করবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। এরকম সোনারঙা সুয্যিমামাকে তো সবসময় পাওয়া যায় না। শীত আসি আসি করছে। আফ্রাদের এই পাড়াটা একটেরে, তাই বেশ খোলামেলাও। ছাদে দাঁড়ালে এখনও ভাগে অনেকটা আকাশটা পাওয়া যায়। হেমন্তের ঝকঝকে আকাশ। প্রতিদিন বিকেলে তাই ছাদের কোণে যে সিঁড়িটা ওভারহেড ট্যাংকে ওঠার জন্য গাঁথা, সেখানে বসে বসে রেলিংএ পা তুলে ঘন্টাখানেক বই পড়ে, নয় গান শোনে।

সবজেটে সিটি শর্টস আর ফিকে নীল ঢোলা গেঞ্জিটা বদলে একটা ক্যালোত পরে গায়ে চড়ালো কুর্তাটা। হাতে ইসমত চুগতাইয়ের ছোট গল্প আর মোবাইল।মা’র ঘরের দরজাটা ভেজানো। উঁকি দিয়েই নিঃশব্দে হেসে ফেললো। রেশমা আক্তার এক মনে হাতের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কোভিড মাকে পুরোপুরি নেটফ্লিক্সে ঢুকিয়ে ফেলেছে।

মা, ছাদে যাচ্ছি। তুমি আসবে? কথার কথা যদিও। আফ্রা খুব ভালো করেই জানে, মা যাবে না। ওসব আকাশ, রোদ, খোলা হাওয়া, এসবের থেকে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে সিরিয়াল আর মুভি দেখাই তার পছন্দ। রেশমা আক্তার শুধু একবার ভাসাভাসাভাবে চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে। এরপর অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়েই না-হ্যাঁ এর মাখামাঝি একটা ভঙ্গি করলেন। আফ্রা বুঝলো, মা এখন ক্লাইম্যাক্সে। মিনা খালা এলে আমাকে চা দিয়ে আসতে বোলো। আমি গেলাম। কথাটা বলেই আফ্রা বেরিয়ে এল। এই ফ্লিপফ্লপটা পরলে পায়ে নয়, পুরো শরীর জুড়ে আরাম লাগে। ছাদের গেটটা ঠেলে খুলে ফেলতেই বিকেলের সোনারঙা রোদ যেন খলবল, ছলবল করতে করতে দৌড়ে এলো। আহ্!

ছাদে উঠলে প্রথমেই চোখে পড়বে অনেক বড় একটা আকাশ, নিচে একটা এবড়ো থেবড়ো নিচু জমি, শেষ হয়েছে অনেকগুলো বড়-মাঝারি গাছের পায়ের কাছে। ওই সবুজ ঝোপড়ার মধ্যে থেকে গজিয়ে উঠেছে একটা চার্চের চুড়া। এখানে এককালে অনেক ক্রিশ্চিয়ান থাকতো। এখনও আছে। ওটার পাশেই কিছুটা জায়গা ছেড়ে আরেকটা মিনার। ওখানেই মসজিদটা। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, দুটো বাচ্চা যেন বাগানে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হাত উঁচু করে ডাকছে একে অন্যকে। একরাশ মিঠে রোদ পুরো ছাদটা ভরিয়ে দিচ্ছে। ওদের বাড়িটাই এই লেনের শেষ বাড়ি। উক্টোদিকেরটা তুবাদের। তাই পানির ট্যাংকটার ওপাশটায় দাঁড়ালেই এপাশের বাড়িগুলোর ছাদ আড়ালে পড়ে যায়, কেবল তুবাদেরটা ছাড়া। ট্যাংক ঘুরে নিজস্ব বসার জায়গাটায় চোখে পড়তেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল আফ্রার। একটা ছেলে বসে আছে। পিছন ফিরে বসা, তাই চেহারাটা নজরে না এলেও মাথার ওপরে ধোঁয়া দেখে সিগারেটের প্রবল অস্তিত্ব টের পেতে কোন সমস্যা হলো না। বোঝাই যাচ্ছে, বান্দা এখানে বেশ কিছুক্ষন ধরে আছে। কারণ সামনে রেলিং ঘেঁসা টবগুলোয়, যেখানে আফ্রার প্রিয় গাছগুলো লাগানো, কয়েকটা দগ্ধ সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে। মাথা গরম হয়ে উঠতে এর থেকে বেশি কী লাগে?

৩.

চোদ্দ বছর আগে তুবার বয়স ছিল দশ। সেই সময় জামালুর রেজা স্ত্রী সুলতানা আর একমাত্র সন্তান তুবাকে নিয়ে এই আটত্রিশ নম্বর জুম্মন কোচোয়ান লেনে চলে আসলেন। শৈশবের প্রতিটা জিনিসের সাথে যে মাত্রার সংযোগ তৈরি হয়, সেটা পরবর্তীতে আর কোন কিছুর সাথেই হয় না। তাই তো ছেলেবেলার জায়গাগুলো সবসময়ের প্রিয়, ছোটবেলার স্কুল সবচেয়ে স্মৃতিকাতরতার জায়গা আর ছোটবেলার বব্ধুটাই সত্যিকারের প্রাণের বন্ধু; তুবার যেমন আফ্রা। দশ আর সাত বছরের দুটো মেয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি করে বেড়াতো। একটা সময়ে দেখা গেল, দিনের বেশিরভাগ সময় হয় তুবা কাটাচ্ছে আফ্রার বাড়িতে নয় আফ্রাকে খুঁজে বের করতে হচ্ছে তুবার বাসা থেকে। জামালুর রেজার ছিল ট্যুরের চাকরি। একা তাই নতুন জায়গায় সুলতানা বেশ হিমশিম খেতেন। তখন থেকেই সুলতানার সংসারের ছোটখাট দরকারগুলো কিভাবে যেন আফ্রার মা রেশমা আক্তার তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। আর সেই থেকে দুই পরিবারে ঘনিষ্ঠতার শুরু।

এর মধ্যে বছর গড়ালো। তুবা যখন আস্তে আস্তে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে উঠছে, তখনই প্রথম ধাক্কা। ট্যুর থেকে ফেরার পথে ডাকাতের সামনে অহেতুক বিরত্ব দেখাতে গিয়ে সুলতানাকে বিধবা করলেন জামালুর রেজা। মাঝরাস্তার ঘটনা; পুরো বাসে একটাই খুন। তুবারা সেই লাস পেল তিনদিন পর। তা-ও আফ্রার বাবা সরাফ উদ্দিনের দৌড়াদৌড়ি না থাকলে সেটা আদৌ হতো কিনা সন্দেহ। এরপরই সুলতানার মধ্যে খুব সুক্ষ্মভাবে অসংলগ্নতা দেখা দেয়। দিনে এমনিতে আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক। কিন্তু রাতে মোটেও ঘুমান না। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস, স্বামীর ফিরতে রাত হচ্ছে। কাজেই দরজা খুলে দেয়ার জন্য জেগে থাকতে হবে।সবার চোখের সামনেই তুবা ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছিল নিজের মধ্যে। কিন্তু সেটা কেউ খেয়ালই করে নি। মাকে ছেড়ে তো আর বাইরে থাকা যায় না। ফলে তুবার ক্লাসে ফাঁক পড়তে লাগলো। যোগাযোগটাও কেমন ছাড়া ছাড়া হয়ে গেল আফ্রার সাথেও, যদিও ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে বাড়িদুটো। আফ্রারও ততদিনে আরও বেশ কয়েকটা বন্ধু হয়েছে। সদ্য কলেজ পেরোনো আফ্রা তখন নতুন দুনিয়ায়। তুবার সাথে আর দিনভর আড্ডা হয় না। মন খুলে কথা বলার মতো আরও কয়েক জোড়া কানও ওর তৈরি হয়েছে। তুবার মতো না অবশ্য কেউ। কিন্তু সেই আগেকার আঠাটা আর নেই।

তুবার এই একটাই মেলে ধরবার জায়গা ছিল নিজের জন্য। সেটাও আস্তে আস্তে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। বিষন্নতা এমনই একটা ধুসর চাদর যেটা একবার মাথার ওপর চাপালে আর নামিয়ে রাখা যায় না নিজে থেকে। দিন দিন চাদরটা লম্বা আর ভারি হতে থাকে। না নেয়া যায় ঠিকমতো দম, না দেখা যায় সীমানা যে হাত দিয়ে তুলে ধরবে। তুবার ডিপ্রেশনের সেই হলো সূচনা। অন্য কেউ খেয়াল না করলেও ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল রেশমা আক্তারের। স্বামীর সাথে আলোচনা করে তখন রেশমাই ঠিক করলেন, তুবার দায়িত্ব একজোড়া শক্ত হাতে এই বেলাই তুলে দিতে হবে। সুলতানার সাথে আলোচনা বৃথা। ততদিনে তার মধ্যে মানসিক অসুস্থতার পুরো লক্ষণ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। তা-ও প্রস্তাবটা দিলেন। ওঁর বড় ছেলে অক্ষরের ক্লাসমেট মিরাজ। তুবার সাথে একদিন দেখাও করিয়ে দিলেন। দুজনের কারোই আপত্তির কিছু ছিল না। ফলে বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর মিরাজ মেস ছেড়ে উঠে এলো তুবাদের বাসায়। সুলতানাকে রেখে তো অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই নিজের পরিচিত পাড়াটাতেই রয়ে গেল ওরা।

রেশমা আক্তার কাজটা খুব বুদ্ধিমানের মতোই করেছিলান। কারণ বিয়ের চার মাসের মাথায় সুলতানার রাতের পর রাত না ঘুমানো শরীর একদিন জবাব দিয়ে দিল ব্রেইন স্ট্রোক করে। তবে অন্তত মরার আগে মেয়ের যে একটা সংসার হয়েছে, এটা দেখে যেতে পেরেছিলেন তিনি। এই বা কম কী?

 

৪.

কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে আফ্রা মৃদুভাবে কাশলো একবার। কাশির শব্দেও ছেলেটার কোন হেলদোল নেই। এবার আফ্রা গলা তুললো,

এক্সকিউজ মি। হ্যাল্লো ও ও।

আজব! এবারও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সেই একই ভঙ্গিতে বাম পা টা লম্বা করে ছেলেটা সিগারেট ফুঁকে চলেছে। ইগনোর করছে ইচ্ছে করে? চন্ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল আফ্রার। আর তখনই চোখে পড়লো, দুটো সরু তার কান থেকে বেরিয়ে একসাথে হয়ে ডান হাতের পাঞ্জায় লুকিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, হেডফোন।

এবার আফ্রা সটান হেঁটে গিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়ায়। ওমা! চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে নেড়ে হেব্বি মৌজে গান গাইছে এবং সেটা ওর নিজেরও খুব প্রিয়; আইয়ুব বাচ্চুর ‘জানি না, কেন অন্ধকারে তুমি একা।’ গলাটা তো বেশ ভালো। দেখতেও মন্দ নয়। এক পলকে যা দেখার জরিপ করে নিলো ও। টিপিক্যাল লাইট স্কাই ব্লু ফেডেড জিন্স পরা। চুলগুলো মাঝারি লম্বা, বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে। মুখটা একটু লম্বা ধরণের, তাতে দু দিনের না কামানো দাড়ির ঝাড়। হুম! নট ব্যাড।

রিস্ট ওয়চের দিকে চোখ এমনিতেই চলে গেল। গেইজের যে এডিশানটা পরে আছে, সেটা স্পর্টস-ওয়চ হলেও চিনতে এক মুহূর্তও লাগলো না। কারণ এই একই এডিশানের লেডিজ ভার্সনটা ওর নিজেরই আছে। ঘড়ির প্রতি আফ্রা সবসময়ই একটু দূর্বল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি জুড়ে প্রায় শোয়ার ভঙ্গিতে বসা বলে স্ট্রাকচার সম্পর্কেও ধারণা পেয়ে গেল। লম্বায় অন্তত পাঁচ নয় বা দশ হবে। ওর থেকে ইঞ্চি তিনেক লম্বা তো বটেই। লোকাস্টের বাকল কোমর পেঁচিয়ে আছে। সুতরাং ফ্যাশন টেস্ট একদম খারাপ না।

হঠাৎ মনে পড়লো, কোথায় ছেলেটাকে ঝাড়বে, তা না, অ্যানালিলিস করে যাচ্ছে। এইসব ভাবাবাবির মধ্যে ওর খেয়াল হয় নি যে, ওর ছায়া ছেলেটের চোখেমুখে পড়া রোদকে আড়াল করে রেখেছে। ফলে একটু পর ছেলেটাও অলস ভঙ্গিতে চোখ খুলেই ধড়মড় করে উঠে বসলো।

জাস্ট একটু কল্পনা করুন। আপনি চোখ খুললেন। ফুট তিনেক সামনে বুকের ওপর দুই হাত জড়ো করে স্কারলেট জোহানসেন আর অ্যানা হ্যাথওয়ের একটা ক্লোন আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে আবার এক মুঠো কাজলের বাঙ্গালিয়ানার মাদকতা জমিয়ে দেয়া। মাথা ঝাঁপিয়ে কার্লি চুল কাঁধের সামনে এবং পিছনে নেমে গিয়েছে। আপনি কী করবেন অথবা ভাববেন?

এ ক্ষেত্রেও অবধারিতভাবেই ছেলেটা আক্ষরিকঅর্থেই হাঁ হয়ে গেল। এরপর অটোম্যাটিক রিফ্লেক্সে সোজা হতে গিয়ে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। পায়ের ওপর রাখা স্মার্টফোনটা ঠাঁই করে ছিটকে দুটো দুর্দান্ত ড্রপ খেয়ে ল্যান্ড করলো ছাদের খরখরে সারফেসে। এসব ক্ষেত্রে বড় পর্দার ফোনের যা হয়, সেটাই হয়েছে মার্ফির ল অনুসারে। নিঁখুত তিনটে ক্র‍্যাক, যেটা কিনা ছেলেটা আরও পরে খেয়াল করবে। আপাতত আচমকা ছাদে নেমে আসা মানবীরূপী সূর্যের তাপে তার দু চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।

‘আপনি আমার জায়গায় বসে আছেন।’ – আফ্রা গলাটা যদ্দুর সম্ভত ততটা খরখরে করে বললো। উচিৎ হচ্ছে না জানে। কিন্তু বিরক্তিও চেপে রাখতে পারছে না।

মা…ম্মানে…?

বলছি যে, এটা আমার জায়গা। আপনি যেটা দখল করে বসে আছেন যেখানে, সেটা।

আ…আপনার জায়গা…? মানে, কিসের দখল?

সিঁড়িটার যে জায়গাটায় আপনি বসে বসে সিগারেট ফুঁকছেন এবং আমারই গাছের টবে ছুঁড়ে ফেলছেন, ওখানে আমি প্রতিদিন বসি। তাই…।

আফ্রা একটু পজ দিলো। বুদ্ধি থাকলে এইবার ছেলেটার উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনও সে সেই একই জায়গায় বসে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, জীবনেও কখনও কোন মেয়ের সামনে পড়েনি। ন্যাকা। বোকা বোকা ভাব দেখানোর এই ট্রিক অনেক দেখেছে ও। কাজেই আর কোন কথা না বলে চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে।

ছেলেটা এবারে একটু নড়ল। চোখটা আফ্রার থেকে প্যান করে চলে গেছে ছাদে পড়ে থাকা মোবাইলটার দিকে। দু ধাপ নেমে নিচু হয়ে সেটটা হাতে নিয়ে দেখল একবার ভুরুদুটো কুঁচকে। তারপর প্যান্টের সাথে ধীরেসুস্থে মুছে নিয়ে আবার বসে পড়লো ধাপটায় এবং আফ্রার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আবার সিগারেট টানতে শুরু করলো। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে অনেকটাই।

এবার আর ধৈর্য রাখতে পারলো না আফ্রা। মেজাজ সপ্তমে উঠেছে। বেলা বয়ে যাচ্ছে। কোত্থেকে এক জুটল এই আপদ? নতুন ভাড়াটে? কোন বাসায় বেড়াতে এসেছে? পরে দেখা যাবে। আপাতত গলায় যথেষ্ঠ পরিমান বিরক্তি ঢেলে বললো,

য়্যুড য়্যু মাইন্ড?

‘নট অ্যাট অল। কেন মাইন্ড করব? সুন্দরী মেয়েদের ওপর আমি মাইন্ড করি না।’ – মুচকি হাসি চোখের কোণে খেলা করছে ছেলেটার।

কিন্তু আমি করি। অভদ্র এবং অসভ্য লোকদের দেখলে আমি মাইন্ড করি। মাথায় রক্ত উঠে যায়। তাই জিজ্ঞেস করছি, ওই জায়গাটা থেকে এক্ষুনি উঠবেন কিনা এবং এজন্য আপনি মাইন্ড করলেও আমার কিছু এসে যায় না।

ও আচ্ছা। উঠে যেতে হবে, আমাকে। কিন্তু আপনি বললেই আমাকে উঠতে হবে কেন? জায়গাটা কি আপনার ব্যক্তিগত? যদ্দুর জানি, ছাদটা কমান স্পেস।

আমার ব্যক্তিগত কিনা, সেটা জানা জরুরি নয়। জরুরি যেটা সেটা হলো ছাদে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। আর সেটা ছুঁড়ে গাছের টবে ফেলাটা নোংরামো। আর হ্যাঁ, আমি বললেই এখান থেকে উঠে যেতে হবে। কারণ এখানেই আমি প্রতিদিন বসি। সেটা এই বিল্ডিং এর সবাই-ই জানে, মনে হচ্ছে একমাত্র আপনি ছাড়া। বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে এত ব্যাখ্যা দিচ্ছি কেন? আপনি কে বলুন তো? আগে দেখিনি তো।

ফাইভ এ তে থাকি। গত সপ্তাহে এসেছি। – ছেলেটা স্পষ্টতই এবার কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে। এরকম আগুনমার্কা একটা মেয়ের চোখ আর মুখ থেকে আগুন বর্ষণের জন্য অন্তত প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে সরে যেতেও আত্মসম্মানে বাধছে। তাই মুখ খুললো যাচ্ছিল কিন্তু আবার থেমে যেতে হলো আফ্রার বাক্যবানে।

ও আচ্ছা, আপনিই সেই যার জন্য রাতবিরাতে আমার মাথার ওপর ধুড়ুমধাড়াম আওয়াজ হয় চেয়ার-টেবিল টানার। দু বার আপনি বারান্দা থেকে পানি ফেলেছেন। বাসায় ছিলাম না বলে বুঝতে পারিনি কোত্থেকে এলো।

আপনার মাথার ওপরে আওয়াজ? তার মানে আপনি ফোর এ তে। দেখুন, আওয়াজটার জন্য আমি দুঃখিত। বুঝতে পারিনি, এতটা শব্দ হবে। আর পানিও আসলে আমি ফেলিনি। নতুন বাসায় ওঠার পর হয়তো আমাদের কাজের মেয়েটা মেঝে ধুতে গিয়ে ভুল করে পানি উপচে ফেলেছে। যাই হোক, সবগুলো ঘটনার জন্য আবারও স্যরি। জানতাম না, জায়গাটা আপনার। চলে যাচ্ছি। আপনি বসুন।

কথাটা বলে ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় এবার। লোফারটা পায়ে গলিয়ে হাঁটা দিতে গিয়েও একটু থমকে দাঁড়ায় একবার।

যাওয়ার আগে অন্তত পরিচিত হয়ে যেতে বাধা নেই নিশ্চয়ই? আমি ইফতি, হাসিব ইফতেখার। আপনি…?

থ্যাংক য়্যু ফর লিভিং মাই প্লেস। যাওয়ার আগে আপনার ফেলে যাওয়া সম্পদগুলো নিয়ে যাবেন দয়া করে।

মুখ ঘুরিয়ে কথাটা বলে সিঁড়িতে বসে পড়ে আফ্রা। নিজের নাম বলে এ রকম ছ্যাবলাদের সাথে আলাপ বাড়ানোর কোন ইচ্ছেই নেই ওর। এদেরকে চেনা আছে খুব ভালো করে। প্রথমে নাম, তারপর খুচরো আলাপ টানবে। স্যরি-ট্যরি বলেছে তো, এবার সুযোগ দিলেই চুইংগামের মতো টানবে সেটা। লাস্টে চাইবে হোয়্যাটস অ্যাপ নম্বর নয় ফেসবুক আইডি। ফাজিল যত্তসব।

ছেলেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বইটা খুলে বসলো আফ্রা। ওর দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো ইফতি। সিগারেটের টুকরোগুলো অবশ্য কুড়িয়ে নিয়েছে মুঠোর মধ্যে। কোঁকড়া চুলের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খুব হালকা একটা অবাক ভাব হাসি ফুটি ফুটিকরছে। আরেহ্! অদ্ভুত তো মেয়েটা! ইফতি এরকম কাউকে দেখেনি এর আগে।

 

৫.

মিরাজের অফিসটা খুব দূরে না হলেও প্রায়ই দেরি হয় ফিরতে। সেই সময়টুকু যদিও তুবার নিজস্ব কিন্তু সন্ধ্যার পরের সময়টা তাই খুব একা লাগে তুবার, ভয়ও। বাইরে থাকা অবস্থায় বারবার ফোন করা মিরাজ পছন্দ করে না। যেমন পছন্দ করে না ওর কিছু নিয়ে বেশি প্রশ্ন করায়।

এই বাড়িটায় কত বছর হয়ে গেল ওর। রান্নাঘরটা এক প্রান্তে। বিয়ের পরপরই একদিন একা রান্না করছিল তুবা আর তখনই বারান্দা দিয়ে বুলেট ঢুকে পড়ে। কাকতালীয়ভাবে সেই সময়টাই লোডশেডিং চলছিল। মিশমিশে কালো বিড়ালটাকে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে সাক্ষাৎ নরকের প্রাণি বলে মনে হয়েছিল ওর। কোন শব্দ না করে বিড়ালটা বারান্দার দরজাটার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সবুজ চোখজোড়া মেলে যেন তুবাকে ডাকছিল – আয়, আয় আমার সাথে। আয় না।

সেদিন ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় তুবা। ভাগ্যিস মিরাজ মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাড়িতে ঢোকে। দরজা যদিও বন্ধই ছিল। কলিংবেল টিপেও যখন সাড়াশব্দ পায়নি কোন, তখন মিরাজ চাবি দিয়ে খুলে ফেলে। সেদিন মিরাজ আফ্রাদের বাসায় গিয়েছিল, সেই আগেকার মতো। গল্প করে আসে রেশমা আক্তার আর সরাফ উদ্দিনের সাথে। দুজনই ওকে খুব স্নেহ করেন। ফেরার পথে হয়তো আফ্রার সাথে দেখা করে যায় কখনও। গল্পও হয়।

সেদিনও আফ্রার ওখানেই গিয়েছিল মিরাজ। গল্প জমে গিয়েছিল খুব চারজনে। এক পর্যায়ে রেশমা আর সরাফ উদ্দিন উঠে যান। বসে ছিলো শুধু মিরাজ আর আফ্রা। তখনই তুবাকে ডাকার কথা বলে ও। কিন্তু ফোনে যখন তুবাকে পেলো না, তখন দুজনেই তড়িৎগতিতে পৌঁছে যায় তুবার কাছে আর আবিষ্কার করে ডাইনিং রুমের মেঝেতে। হাসপাতালে নিতে না হলেও ওর জ্ঞান ফিরতে সময় লেগেছিল। পরদিনই বারান্দায় গ্রিল লাগানো হলো। মিরাজ খুব ঠাট্টা করে বললো,

বিড়াল দেখেই অজ্ঞান? বাঘ দেখলে তো হার্ট ফেইল করবে।

তুবা উত্তর দেয় নি। ক্লিষ্ট হাসি হেসেছিল। ওর এই ভুতের ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা মিরাজ জানে। এরপরও ঠাট্টা করে। তুবা বোঝে, ব্যাপারটায় মিরাজের বিরক্তি লাগে, ন্যাকামো মনে করে। আজ প্রথম বাইরের কারও সামনে ঠাট্টাটা করলো। আফ্রা যদিও তুবার এই দূর্বলতাটুকু জানতো, কিন্তু সেটা নিয়ে যে মিরাজ ভাইয়ের এতটা বিরক্তি, ভাবতেই পারেনি। অদ্ভুত তো!

পরের দিনই তুবাকে জিজ্ঞেস করেছিল ও। কোন গোলমাল হচ্ছে নাকি? কিন্তু তুবা যে মুখ চাপা। কিছুই বুঝলো না আফ্রা।

গোলমাল তো অবশ্যই আছে। তুবা সেটা কাকে বলবে? প্রিয়তম বান্ধবীকেও অনেক কথা বলা যায় না। তুবার সমস্যাটা ওর রান্নাঘরের জানালাটা নিয়ে, যেটা থেকে আফ্রার বাড়ির ছাদ অব্দি দেখা যায়।

 

৬.

শুনছেন?

মৃদু ডাকটা শুনে ঘাড় ঘোরায় ইফতি এবং দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে। আজ অবশ্য সেদিনকার মতোন আক্রমণাত্মক লাগছে না। কিন্তু বিশ্বাস কি? নিঃসন্দেহে কিছুটা ছিটগ্রস্থ। নইলে একজন অচেনা মানুষকে এভাবে অপদস্ত করে? তার ওপর আজও ইফতির দু আঙ্গুলের মাঝে সিগরেট জ্বলছে। ভাবেই নি, এই সন্ধ্যায় কেউ আসবে। কৈফিয়তটা আগেই দিয়ে দেয়া ভালো।

আ’ম রিয়্যালি স্যরি৷ ভেরি, ভেরি স্যরি। আসলে খেয়ালই ছিল না যে এখানে আবার বসে পড়েছি। ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে এদিকটায় চলে এসেছি, টের পাই নি। আমি এক্ষুনিই নেমে যেতাম।এই একটাই ধরিয়েছি, বিশ্বাস করুন।

না, না। আমি আসলে ও কথা বলতে আসি নি।

তারপরও আমি দুঃখিত। ছাদটায় ভাড়াটেদের ঘোরাঘুরি না করার নিয়মটাও জানি। কিন্তু…।

আহ হা! আপনি দেখি একাই বলে যাচ্ছেন। আমি কি একবারও এসব বলেছি? – এবার হেসে ফেলে আফ্রা। বুঝতে পারছে, ছেলেটা ওর সেদিনের আচরণটা মোটেও ভোলে নি। ‘আমি আসলে আপনাকে স্যরি বলতে এসেছিলাম।’

আমাকে! স্যরি…!!! মানে? ঠিক বুঝতে…।

আচ্ছা, আমি কি ‘মানে বই’? আপনি এত ‘মানে, মানে’ করেন কেন?

স্যরি। স্যরি। আর বাধা দেব না। স্যরি। প্লিজ বলুন। আসলে একটু…মানে, ইয়ে…মানে…

আবার মানে? উফ্! যাক। সেদিন আপনার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। সেইজন্য আমি খুবই, খুবই দুঃখিত, ফ্রম হার্ট। আর…আর মোবাইল ফোনটার জন্য আরও অনেকটা দুঃখিত। ওভাবে চমকে না দিলে…। ইশ্! দামি ফোনটা আমার কারণেই ভেঙ্গে গেল। আমার না খুবই লজ্জা লাগছে।

এইবার ইফতিও হেসে ফেলে। সন্ধ্যা আর রাতের এই সন্ধিক্ষণটা খুব রহস্যময়। পুরো পৃথিবীটা কেমন আচমকা বদলে যায়, বদলে যায় মানুষও। আফ্রাকে আজ একদমই অন্যরকম লাগছে এইজন্যই কি?

‘আরে। স্যরি বলছেন কেন? আমি কিছুই মনে করিনি। আর ফোনের কথা বলছেন?’ – এইটুকু বলেই যেন ম্যাজিশিয়ানের মত হিপ পকেট থেকে বের করে সামনে বাড়িয়ে ধরে ফোনটা। নোট ২০ আল্ট্রার বিশাল স্ক্রিন স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে ছিটিকে আসা আভায় চকচক করছে একদম দাগহীনভাবে।

স্ক্রিন প্রটেক্টর ছিল। বেঁচে গেছে এইজন্য। কাজেই আপনার মন খারাপের কোন কারণই রইলো না, বুঝলেন?

থ্যাংক য়্যু…ইয়ে…

বলেই একটু থমকায় আফ্রা। ছেলেটা নামটা কী যেন বলেছিল? ওর মনের কথাটা বুঝেই যেন ছেলেটা চোখে দুষ্টুমিটা ঝলসে ওঠে।

সেদিন যেরকম রেগে ছিলেন, আমার নামটা শুনলেও মনে থাকার কথা না। কাজেই আজ আরেকবার আনুষ্ঠানিক পরিচয় হোক। আমি হাসিব ইফতেখার। বন্ধুরা ইফতি বলে ডাকে। আপনার নাম অবশ্য আমি জানি, যদিও সেদিন বলেন নি, কিন্তু জানি। আফ্রা, তাই তো?

কিভাবে জানলেন?

নিচে লেখা ফোর-এ এর নেইম প্লেটে আপনার পুরো নামটা আছে যদিও কিন্তু ডাক নামটা জেনেছি সেদিন আপনার মা’র ডাক থেকে। গত পরশু আপনি বোধ হয় মোবাইলটা ফেলেই নেমে গিয়েছিলেন। বারান্দা থেকে উনি ডাকলেন আপনাকে। আমিও তখন আমাদের বারান্দাতেই ছিলাম।

হুমম…। ইন্টেলিজেন্ট। সেদিন আসলে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি আপনার সাথে। পরে ইদ্রিস চাচার কাছে জানলাম আপনি ওনার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এ কথাটা বললেই হতো। ইদ্রিস চাচা আমাকে যে কি আদর করেন। আমি না খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছি ওঁর কাছে।

বলার কি কোন সুযোগ ছিল সেদিন? – হা হা করে হেসে ফেলে এবার ইফতি। আফ্রাও যোগ দেয়। ছেলেটার মধ্যে সহজ একটা ব্যাপার আছে কোথায়। চেনা চেনা মনে হয়।

তারপর আর কি? যে ভাবে দুটো সদ্য পরিচিত মানুষ আলাপ শুরু করে, ওদেরটাও তেমনিই শুরু হয়। ইফতি এ বাসায় উঠেছে দোতলার ইদ্রিস সাহেবের রেফরেন্সে। উনি আফ্রার বাবার প্রতিবেশি এবং বন্ধুও। ইফতি ওই ইদ্রিস সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ কলিগের কাজিন। এতদিন ঢাকার বাইরে ছিল। এখন হেড অফিসে চলে এসেছে।

কথায় কথায় আরও জানা গেল, ইফতির বাবা মা নিজের শহর টাঙ্গাইলেই থাকেন, বড় মেয়ের সাথে। ওর চাকরিটা একটা ডেভলপমেন্ট ফার্মে। বেশবঘোরাঘুরির মধ্যে থাকতে হয় মাসের বড় একটা অংশ। বাকি সময়টা ঢাকার অফিসে আর বাসায় কাজে কেটে যায়। নেশা বলতে একটাই, বই পড়া আর মুভি দেখা।

এই লাস্ট লাইনেই আফ্রা মুগ্ধ। বইয়ের পাগল তো ও-ও। দুজনের পছন্দ এক জায়গায় মিলতে আর সময় লাগেনি। আফ্রা তখন ওর গল্প বলে, ওর শৈশবের গল্প, য়্যুনিভার্সিটির গল্প, তুবার গল্প। কথা বলতে বলতে দুজনই এসে দাঁড়িয়েছে রেলিং এর কাছে। সাবধানে পুরোনো রেলিংটায় ভর দিয়ে দাঁড়ায় দুজন। তুবাদের বাসাটা দেখা যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালায় তুবার পাশটা দেখতে পেয়ে আফ্রা ডেকে ওঠে,

অ্যাই তুবা, অ্যাই। কী করছিস রে? চলে আয় না?

দূর থেকে তুবাও হাত নাড়ে। ”আজ না। মিরাজ চলে আসবে আরেকটু পর। নাস্তা বানাতে হবে।’

অ্যাই শোন না, এ হচ্ছে ইফতি। তুই আসলে পরিচয় করিয়ে দেব।

তুবা এবার কী বলে, ঠিক শোনা যায় না। তখনই একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছিল। তবে ওর হাত নাড়ার বদলে ইফতিও হাত নাড়ে।

পাশ থেকে আফ্রার গালে আলো এসে পড়েছে। জ্বলজ্বলে চোখদুটোয় অকৃত্রিম আনন্দ। ইফতির বুঝতে একবিন্দুও সমস্যা হয় না, প্রাণের বন্ধু কিভাবে ভালোবাসার আলোড়ণ তুলতে পারে। মুগ্ধ চোখে এই অদ্ভুত, পাগলামতন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো ইফতি।

৭.

একটা ময়াল সাপ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে তুবার। মুখের ওপর এসে পড়ছে দুর্গন্ধময় বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
হাঁসফাঁস করে জেগে উঠে বড় করে দম নেয় একবার। স্বপ্নে দেখা সাপ না। বরং তার থেকেও বড় দুঃস্বপ্ন অভিনীত হয়ে চলছে এই মুহূর্তে ওর ওপর। এ এক এমন নাটক, যাতে ওর বাধা দেয়ার কোন ক্ষমতা নেই। আদিম কোন প্রাণির মতো ওকে খুঁড়ে চলেছে মিরাজ। সামান্যতম বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেই মিরাজের হিংস্রতা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। বাইরে থেকে খুব স্বাভাবিক, ভদ্র মানুষটার এই আরেকটা চেহারা তুবা ছাড়া আর কেউ কোনদিন দেখেনি, জানবেও না। আর জানালেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে মিরাজ একজন ভয়ংকররকমের স্যাডিস্ট।

আগাগোড়া হোস্টেলে কাটানো মিরাজের বাবা-মা দু’জনই শৈশবেই মারা গিয়েছেন। একমাত্র সন্তান বলে পিতৃদেব যে অশেষ বিত্ত রেখে গিয়েছিলেন, তা তো নয়ই। বরং মারা যাওয়ার পর দেখা গেল অনেকের বিত্তই তাঁর কাছে ছিল। অর্থাৎ ধার। ফলে চোখের পলকে অবশিষ্ট খুদকুঁড়োগুলো হাওয়া হয়ে গেল। এক দূর সম্পর্কের চাচা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রেখেছিলেন নিজের কাছে। অবশ্য অত্যন্ত অনিচ্ছায় কারণ তাঁর নিজেরই চারটি সন্তান এবং মাসিক আয় দিয়ে দু’মুঠো জোটাতেই জিভ বেরিয়ে যেত। তাই একটা ফ্রি মিশনারি স্কুল দেখে সেখানে প্রথম ক্ষেপেই চালান করে দিলেন হতভাগাটাকে।

অক্ষরের সাথে মিরাজের বন্ধুত্ব হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে। দুজনের সাবজেক্ট একই – পরিসংখ্যান। যেদিন এক উঠতি পাতি নেতা ধার না দেয়ার অপরাধে কলার ধরে ঝাঁকাতে দেখল, ডাকাবুকো অক্ষরের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। অক্ষর সেদিন জুয়েল, মানে পাতি নেতাকে খুব ঠান্ডা স্বরে থামিয়ে না দিলে মিরাজের খবর ছিল। অক্ষর এমনিতে ক্লাসে পপুলার। নেতা আর তাকে ঘাঁটায় নি। মাঝখান থেকে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল মিরাজ আর অক্ষরের মধ্যে। আস্তে আস্তে অক্ষরের বাসায় আসা যাওয়া শুরু হলো। চেনা পরিচয় হলো সবার সাথে, এমনকি আফ্রার অরাণের বান্ধবী তুবার সাথেও।

বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় তুবার মনে হয়েছিল, মিরাজের বড় রকমের কোন একটা সমস্যা আছে। খটকাটা লাগতো যখন ওই সময়টা তুবাকে কষ্ট দিয়ে যেন ওর আনন্দ আরও বেড়ে যেত। প্রচন্ড বিস্ময়ে এরপর আবিষ্কার করে তুবা, ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই মিরাজের। তার দরকারটুকু শুধু সে উঠিয়ে নিচ্ছে, তা সে যখনই লাগুক না কেন। তুবা কি অসুস্থ, নাকি ক্লান্ত, নাকি ঘুমন্ত, নাকি মন খারাপ – কিছুই ম্যাটার করে না মিরাজের কাছে। খুব কোমল, অসাধারণ আনন্দময় একটা ব্যাপার যে বিভৎসরকমের নারকীয় করে তোলা সম্ভব, সেটা বোধহয় মিরাজ ছাড়া আর কেউ পারবে না। যদিও অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল হয়েছে উলটো। মিরাজ বাড়িয়ে দিয়েছে বিকৃতি।

এইটুকু পর্যন্ত হলেও সম্ভবত তুবা হয়তো মানিয়ে নিত। মেয়েরা অনেকটুকু মানিয়ে নিতে পারে, মেনেও নিতে পারে, তা মন যা-ই বলুক না কেন। সব মানুষ তো একরকম নয়। শারীরিক কষ্টের অংশটুকু না হয় সহ্যই করে নিত ও। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর হলো মিরাজের বলা কথাগুলো। ওই বিশেষ সময়টায় মিরাজ তুবার কানে উগরে দেয় ওর মনের ভয়ংকর সব ফ্যান্টাসিগুলো। তুবাকে দাঁতে দাঁত চেপে শুনে যেতে হয় ওইসব ইচ্ছের কথা। মিরাজ বাধ্য করে ওকে ওই ভুমিকায় অংশ নিতে। এ যে কি অকল্পনীয় নারকীয় মানসিক যন্ত্রণা, সেটা পৃথিবীর অন্য কারও পক্ষে ন্যুনতম কল্পনা করাও অসম্ভব।

ওই যে বলে না, নরকে মানুষকে বারবার মৃত্যুর স্বাদ দেয়া হবে? মিরাজ সেটাই করে তুবাকে, প্রতিরাতেই, একটা বিশেষ নামে ডেকে। চারদিক থেকে দলা পাকানো ঘৃণা তুবাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলতে থাকে।

কী করবে তুবা? কি করতে পারে ও?
খুন করবে? কাকে খুন করবে?
নিজেকে? মিরাজকে? নাকি ওই অন্যজনকে?

৮.
‘আজকে ওকে বলতেই হবে কথাটা। আর পারছি না। উঁহু, অসম্ভব।’
তিনটা আলাদা মানুষ কাকতালীয়ভাবে ঠিক একই চিন্তা করছে, একজনকে কেন্দ্র করেই। পার্থক্য কেবল প্রত্যেকের উদ্দেশ্য, মানসিক অবস্থা আর পরিস্থিতিতে। তিনজনই ভাবছে, কথাটা শুনে শ্রোতার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে – সম্পর্কের শেষ? না কি নতুন মাত্রা যোগ হবে সম্পর্কে?
আলাদা তিনটি দিনে আলাদা তিনজন মানুষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজেকে উন্মুক্ত করলো ওই বিশেষ ব্যক্তিটির কাছে। একান্তেই, কারণ দ্বিতীয় কারও উপস্থিতি খুব সাবধানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। শুধু বেছে নেয়া সময়টা ছিল ময়ুরকন্ঠী রাতের আড়ালে। তারপর…?
সেই সকালটায় আকাশে পেঁজা পেঁজা মেঘ জমেছিল অনেক। খুব মিষ্টি, মন ফুরফুরে করে দেয়া একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। আটত্রিশ নম্বর জুম্মন কোচোয়ান লেন তখন সবে জাগতে শুরু করেছে। রোজকার মর্নিং ওয়কে বেরোচ্ছেন ইদ্রিস সাহেব ও তাঁর স্ত্রী। এই পাড়ায় এঁরাই প্রথম জাগেন। সদর দরজা পেরোতেই বোঁ করে মাথাটা ঘুরে উঠলো ওঁর৷ মুহূর্তেই গলা বেয়ে বমি উঠে এসেছে৷ ততক্ষনে ওনার স্ত্রীর গগনবিদারী চিৎকারটা পুরো লেন কাঁপিয়ে দিলেও ইদ্রিস সাহেব স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে।

ছাল ওঠা পিচের রাস্তাটায় অচেনা এক মহাদেশের ম্যাপ তৈরি করেছে গাঢ় কালচে লাল একটা তরল। অবশ্য এখন আর সেটা তরল নেই। প্রায় জমে শক্ত হয়ে কোঁকড়া চুলগুলোকে জট পাকিয়ে আটকে ফেলেছে রাস্তার সাথে। শুধু খোলা চোখদুটো সটান বিছানো সামনের দিকে। কপালের চামড়ার উঁচুনিচু অসামঞ্জস্যতাই বুঝিয়ে দেয়, ছতলার ওপর থেকে পড়ার ধাক্কা খুলিটা আর নিতে পারেনি।

কালো রক্তের মধ্যে আফ্রার প্রায় এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাওয়া মাথাটায় এখনও আটকে আছে হলুদ হেয়ারব্যান্ডটা। যেন গাঢ় বেগুনি ঝোপের মধ্যে হলুদ একটা ফুল ফুটে আছে। গল্পটা এখানে শেষ করে দেয়া যায়। কিন্তু গল্পটা তো আসলে আমার নয়। তুবা, ইফতি, আফ্রা আর মিরাজ ওদের কাহিনী কিভাবে শেষ করতে চেয়েছিল বা করেছিল, সেটা আমিও জানি না। নগন্য এই লেখক কেবল ওদের জায়গাটা থেকে দেখার চেষ্টাই করতে পারে। ঠিক যেভাবে সিনেমা হলের পিছনের সিটে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দর্শকের আর কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই।

৯.

মুনলাইট সোনাটা বেজে উঠতেই আফ্রা চকিতে তাকাল ফোনের দিকে, ইফতি। চোখটা এমনিতেই ঘড়ির দিকে চলে গেল। রাত সাড়ে নটা।
অ্যাই, কী খবর রে?
হ্যালো…হ্যালো…আফ্রা?
ফোনে কেমন খড়খড় শব্দ হচ্ছে ওপাশ থেকে। এই বাড়িটায় এই এক সমস্যা। জায়গায় জায়গায় নেটওয়র্ক ঝামেলা করে।
হ্যাঁ, ইফতি, শুনছি তো। বল। তুই শুনতে পাচ্ছিস না? – একটু জোরেই বলে উঠলো আফ্রা এবার।

আপনি থেকে একেবারে তুই তে স্কিপ করে আসাটা অনেকদিন আগেই সেরে নিয়েছে ওরা। আফ্রার আবার আপনি বা তুমি বেশিক্ষন পোষায় না। এই কমাসে ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধরণের সরল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। কৃতিত্বটা অবশ্য ইফতিরই বেশি৷ মানুষের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবার এবং সেটাকে নিজে অনুধাবন করবার বিরল গুণটা আছে ওর। ফলে মনের কথা উজাড় করে দিতে আফ্রার কোন সমস্যাই হয় না। এর মধ্যে তুবার সাথেও একদিন পরিচয় হয়ে গেছে।
হ্যাঁ…হ্যাঁ…এখন শুনতে পাছি। তুই কি খুব ব্যস্ত? কী করছিলি?

উম…কাল একটা কুইজ আছে। সেটায় ঘস্টাচ্ছি। কেন বল তো?
না মানে, বলছিলাম কি, একবার ছাদে আসবি নাকি?
ছাদে…! এখন…!! কেন? ছাদে কী করবো? আর তুইই বা ছাদে কী করছিস? তোর না পরশু ফেরার কথা? যাস নি?
ক্যান্সেল হয়ে গেছে রে। কপাল ভালো। তাই বাড়ি ফিরে একটা ঘুম দিলাম জম্পেশ। উঠে ছাদে এসেছি একটু আগে। আয় না একবার। মামা আজকে খুব মুডে আছে।

মামা মানে?

আরে, চাঁদা মামা। হেব্বি একটা লাইট জ্বালিয়েছে। মনটা একদম বিন্দাস মেরে যাচ্ছে। আসবি?

এক মুহুর্ত ভাবে আফ্রা। ক্লাস টেস্ট না কি জোছনা? রাতে কখনই ছাদে ওঠেনি নি ইফতির সাথে। কেন যেন মনে হয়েছে, মা পছন্দ করবে না। আর ইফতিটারই বা হলো কী আজ? একদম চন্দ্রাহত।

কি রে? কী ভাবছিস? চলে আয়।

‘আচ্ছা। আসছি।’ – সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল আফ্রা।

কোঁকড়া চুলগুলো ঝোপ্পা হয়ে আছে। হলুদ হেয়ারব্যান্ডটা দিয়ে আটকে নিয়ে মার ঘরে উঁকি দিল একবার। ঘুমাচ্ছে। শরীরটা কদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যান। বাবাও এজন্য মার কাছ থেকে সহজে সরছে না। থাকুক দুজন। দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে ছাদে উঠে এলো আফ্রা এবং মুগ্ধ হয়ে গেল।

কি রে? জম্পেশ লাগছে, বল?

উফ্! সত্যিই পাগল হয়ে যাব আরও কিছুক্ষন থাকলে।

এরকম চাঁদমামাকে আগে দেখেছিস? আমি তো তখন থেকে মামাকে স্যালুট দিয়ে যাচ্ছি।

ভাগ্যিস তুই আজ যাস নি। নইলে আমাকে ডাকতি কিভাবে? অ্যাই, থ্যাংক য়্যু রে। থ্যাংক য়্যু সৌ মাচ, ইফতি।

দুজনেই এবার চুপ হয়ে যায় আচমকা। এখন লোডশেডিং চলছে। স্ট্রিট বালবগুলো জ্বলছে না বলেই চাঁদের রূপালী আলো ভাসিয়ে নিচ্ছে ছাদগুলো, পানির ট্যাংকটাকে, ঘুমিয়ে থাকা রাস্তাটা আর এক ঠেঙ্গে ল্যাম্পপোস্টদের।

আফ্রা ভাবছিল…আসলে কিছুই ভাবছিল না। বরং এই অদ্ভুত মায়াময় সমস্ত প্রকৃতিটাকে শুষে নিচ্ছিল যেন। বাতাসটাও যেন আজ প্ল্যান করেছে ওর চুলগুলোকে এলোমেলো করার। আবেশে চোখ মুদে আসছে ওর। তাই ঘাড়ের ওপর খুব আলতো স্পর্ষটা টের পেলও খুব আস্তে আস্তে। কানে একটা ফিসফিসে স্বর ওকে ডাকলো,

আফ্রা?
উম্?
একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবি।
বল না?
আমাকে ভালোবাসতে দিবি, তোকে?

চমকে আয়ত চোখ দুটো ফেরাতেই দেখলো, এক জোড়া ঠোঁট একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। আফ্রা, আর যাই হোক মেয়েই তো, এই মুহূর্তে বুঝতে পারছে, ইফতি যে কথাটা বললো, সেটা ওর অনেক, অনেকদিনের আটকে রাখা একটা প্রশ্ন। কিন্তু সব প্রশ্নের কি চট করে উত্তর হয়?

আমি…আমি তো…ওভাবে…তুই আসলে, মানে…আমি…

এবার আফ্রার পালা। আচমকা অপ্রত্যাশিত কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ জানে না কী করতে বা বলতে হয়। ইফতি আবার বলে ওঠে,

নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কথাটা কিভাবে বলবো। জিজ্ঞেস করেছি, বন্ধুকে কি ভালোবাসা উচিৎ? অনেক ভেবে দেখলাম, তুই আমার খুব ভালো বন্ধু বলেই তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি। এটা কখন প্রেম হয়ে গিয়েছে, আমি জানি না। বন্ধুর সাথেই প্রেম করাটা সবচেয়ে সেইফ। কারণ আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারি জলের মতো। আজ কথাটা না বললে নিজের কাছ থেকেই মুক্তি পাচ্ছিলাম না। তুই শুধু বল, আমি কী করব? তোর যেটা ইচ্ছা বল। আমি কিচ্ছু মনে করবো না। কিন্তু প্লিজ, চুপ করে থাকিস না। জাস্ট বল, আমি যে তোকে ভালোবা…

খেয়াল করলে ইফতি দেখতে পেত, আফ্রার ঠোঁটের কোণে প্রায় দেখাই যায় না এমন আবছা হাসি উঁকি দেব দেব করছে। ইফতির কথা শেষ করতে দেয় না আচমকা খুব নরম একটা স্পর্ষ। স্ট্রবেরির সুগন্ধ আর অনাস্বাদিত একটা স্বাদ আচমকাই ওর ঠোঁটজোড়ায় লেপ্টে গিয়েছে। গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে এবার আফ্রার ফিসফিস কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

সত্যিই ভালোবাসবি তো? সবসময়?
সবসময়। সবসময়। সারাজীবন।
তাহলে আমিও।

ইফতি দুহাতে জড়িয়ে ধরে আফ্রার পেলব গাল। সিগারেটের গন্ধ মাখা একটা আগ্রাসী পুরুষালি মুখ ঝুঁকে পড়ে। কোঁকড়া চুলগুলো উথালপাথাল হাওয়াতে দুজনকেই যেন আড়াল করে দিচ্ছে সব কিছু থেকে। আফ্রার হাঁটুতে কোন জোর নেই। পুরো শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। আফ্রা দুহাত দিয়ে হেলান দেয় রেলিং এ।

ঠিক সেই মুহূর্তেই খসে পড়লো রেলিং এর এক চাপড়া ইট-বালির স্তুপ। আর ইফতির হাত থেকে স্লো মোশানে ছুটে গেল আফ্রার গাল।

১০.
খালাম্মা, কেমন আছেন?
এই আছি আর কি বাবা। তুমি কেমন আছ? তুবা? ও আর আসে না কেন?
এই ব্যস্ত থাকে। আফ্রা কোথায়?
আছে ওর রুমে মনে হয়। দেখ গিয়ে। তুবাকে বোলো তো আসতে। অনেকদিন দেখি না।
আচ্ছা।

কথাটা বলে রেশমা আক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো মিরাজ। তুবাকে নিয়ে কথা বলতে ওর ইচ্ছা করে না। জানে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। কিন্তু সেই প্রথম থেকেই মিরাজের মাথা, মন একটা নামই আচ্ছন্ন করে রেখেছে – আফ্রা। অফিস থেকে ফিরে তাই মাঝে মাঝে চলে আসে এখানে। কখনও আফ্রাকে পায়। গল্প করে। আফ্রার অবশ্য কোন সমস্যা নেই। বড় ভাইয়ের বন্ধুকে দেখছে অনেক বছর। এখন তো আবার প্রিয় বান্ধবীর বর। দেখা হলেই তুবাকে জড়িয়ে ঠাট্টা করবে। মিরাজের তখন মনে হয়, এর থেকে আফ্রা যদি একটা পেরেক ওর মাথার তালুতে বসিয়ে দিত, ওর বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না। আফ্রার মুখে তুবার নামটা শুনতেও চায় না ও।

আজ আফ্রার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, ও নেই। তার মানে ছাদে আছে নিশ্চয়ই। যাবে কি না, কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। তুবা আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছিল। ওর নাকি একা সন্ধ্যাবেলায় ভয় লাগে। ধুত্তোর ভয়। আফ্রাকে কেন আর নিয়মিত দেখতে পারে না, এই নিয়ে মিরাজের আক্ষেপের শেষ নেই। আগে তুবা নিয়মিত যেত। সেই সাথে মিরাজও৷ গল্প হতো তিনজনে। তুবা আর আসতে চায় না। মিরাজ জানে কেন। মাঝে মাঝে বলেছেও তুবাকে, ‘যাও না কেন আফ্রার ওখানে?’ একটা শব্দও উচ্চারণ না করে তুবা শুধু তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সেই দৃষ্টিতেই সব উত্তর। মিরাজ আর পাত্তা দেয় নি। এখনও বন্ধুর বাড়িতে ওর অবারিত দ্বার। তাই নিজেকে সামলাতে পারে না। কিন্তু ইদানিং মনে হচ্ছে, আফ্রা যেন ঠিক সহজ হতে পারে না ওর সামনে। অস্বস্তিতে ভোগে। মিরাজের সাথে বেশিক্ষন একা গল্প করতে চায় না। হয় মাকে ডাকে নয় তুবার কথা জিজ্ঞেস করে। কয়েকদিন তো তুবাকেও ফোন করে ডেকে এনেছিল।

মিরাজের একদম ভাল্লাগে না। যতদিন যাচ্ছে, আফ্রা ওর অবসেশন থেকে ম্যানিয়ায় পরিনয় হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কেমন অবোধ পশুর মতো মনে হয় ইদানিং। আফ্রাকে না পেয়ে পেল তুবার মতো একজনকে। ইশ্! কেন যে বিয়েতে রাজি হয়েছিল? কেন যে তখন সাহস করে আফ্রাকে বলেনি?

শয়নে স্বপনে আফ্রাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মিরাজ নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আফ্রাকে না পাওয়ার হতাশা আর ওকে নিয়ে ফ্যান্টাসি একসাথে মিশে গিয়ে আরও পাশবিককভাবে উগরে দেয় তুবার মধ্যে। আজ মিরাজ তাই ঘোরের মধ্যে চলে এসেছে। আফ্রার কাছে একটিবার ভিক্ষা চাইবে। ওর কাকুতিতে নিশ্চয়ই আফ্রা বুঝবে, ও কতটা অসহায়। তরতর করে ছাদে উঠে এলো ও। জানে আফ্রা কোথায় থাকতে পারে। ইদানিং ইফতি নামের একজনের কথা শুনছে আফ্রার কাছে। দেখাও হয়ছে একদিন। গা জ্বলে গেছে মিরাজের। আফ্রা মনে হয় একটু ঢলে পড়ছে। হারামজাদা! আর জায়গা পেল না থাকার। আজ আবার ব্যাটা থাকবে না তো? নাহ! সেটা ঠিক জেনেই এসেছে। গতকালই কথায় কথায় তুবার মাধ্যমে জেনেছে, ছেলেটা ঢাকার বাইরে।

ঠিক যেখানটায় ভেবেছিল সেখানেই আফ্রা বসে আছে। গুনগুন করে গান গাইছে। পায়ে পায়ে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায় মিরাজ। মেয়েদের মনে হয় আলাদা একটা সেন্স থাকে। আফ্রাও পেল। চট করে ঘাড় ঘোরায় ও মিরাজের দিকে। উঠে দাঁড়ায়।

মিরাজ ভাই, কী ব্যাপার?

আফ্রা…। – মিরাজের গলাটা কেঁপে যায় হঠাৎ। আজ সব বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর। এই স্বরেই আফ্রা বুঝে যায়, কোন একটা গন্ডগোল হচ্ছে।

কী হয়েছে মিরাজ ভাই? আপনি ঠিক আছেন তো? তুবা?

প্লিজ আফ্রা, ওই নামটা তুমি আমার সামনে উচ্চারণ কোরো না।

মানে? কী বলছেন?

আফ্রা, আমি…আমি…তোমাকে একবার চাই।

চাই মানে?

তুমি বোঝো না আমি কি চাই? বোঝো না? প্লিজ আফ্রা, আমি আর পারছি না। তোমাকে একবার আমি চাই, জাস্ট একবার। কেউ জানবে না, টেরও পাবে না।

ছিঃ। পাগলের মতো কী যা তা বলছেন?

অকৃত্রিম ঘেন্নার সাথে শব্দটা ছিটকে এলো আফ্রার কন্ঠ থেকে। আর সেটাই যেন মিরাজের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রাথমিক বাধা তো আগেই ভেঙ্গেছে। এবার মিরাজ আচমকা চেপে ধরে আফ্রার দু কাঁধ। জ্বরতপ্ত মানুষের মতো কাঁপছে ওর পুরো শরীর। মুখটা জোর করে গুঁজে দিতে যায় ওর গলার কাছে। আগুনের মতো গরম নিঃশ্বাসে আফ্রা পিছিয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। আর মিরাজও ওকে আঁকড়ে ধরে টেনে আনে বুকের কাছে।

আফ্রার মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। ওর কী করা উচিৎ এই মুহূর্তে, মাথায়ও আসছে না। গায়ে, পায়ের সব জোর যেন ঘটনার আকস্মিকতায় উবে গেছে ওর। শুধু টের পাচ্ছে, মিরাজের হাতদুটো পাগলের মতো ওর সারা শরীরের যত্রতত্র স্পর্ষ করতে চেষ্টা করছে।

স্বাভাবিক রিফ্লেক্স কাজ করলো এইবার। মাথাটা ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়ার সময় একবার চোখে পড়লো তুবাদের বাড়িটার দিকে। জানালার ফ্রেমে তুবাকে দেখতে পেল ও এক পলক। এদিকেই তাকিয়ে আছে। জোরে ঠেলে দিল ও মিরাজকে। সরে যাচ্ছে মিরাজ, সরে যাচ্ছে ছাদ, সবকিছু। জোড়াতালি দেয়া রেলিংটা ওর ভেঙ্গে পড়া ইঁট বালির স্তুপের সাথে আফ্রাকেও যেন টেনে নিচ্ছে নিচের দিকে। যেন অনন্তকাল ধরে আফ্রা হাত বাড়িয়ে সিঁড়িটার ধাপ ধরতে চাইছে আর সেটা ক্রমেই দূরে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। শুধু ‘তুবা’ ডাকটা প্রলম্বিত হতে থাকলো।

১১.
“য়্যু ফিল আপ মাই সেন্সেস, লাইক আ নাইট ইন দ্য ফরেস্ট।
লাইক আ মাউন্টেইন ইন স্প্রিং টাইম,
লাইক আ ওয়ক ইন দ্য রেইন…”

আফ্রার কলার টিউনে জন ডেনভার গেয়ে চলেছেন চিরকালের সবচেয়ে সহজ প্রেমের অনুভূতিটা। তুবা এক মনে শুনছে, অনেকদিন পর। এককালে এই গানটা ওদের দুজনেরই অসম্ভব প্রিয় একটা গান ছিল। কট করে মাঝখানে কেটে গিয়ে ভেসে এলো সেই ঝলমলে কন্ঠ,

হ্যালো…তুবা। কি রে?
আফ্রা?
তোর গলা এরকম লাগছে কেন? কী হয়েছে রে?
কিছু না।
কিছু না মানে? আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছিস তুই? কি হয়েছে, বল?
বললাম তো, কিচ্ছু না।
আবার কিছু না। নিশ্চয়ই মিরাজ ভাই। কী করেছে তোকে? কী নিয়ে ঝগড়া? অ্যাই তুবা, প্লিজ। চুপ করে থাকিস না।
বিশ্বাস কর, মিরাজের সাথে আমার ঝগড়া হয় নি। কখনও হয় না।
তাহলে কাঁদছিস কেন?
তোর জন্য।
আমার জন্য মানে?
আফ্রা, তুই…তুই…
আমি কী? বল।
আমার কিছু কথা বলার আছে আফ্রা। সামনাসামনি বলতে চাই।
বল না। এত রহস্য করছিস কেন? আমি আসবো?
উঁহু। আমিই আসবো।
কখন আসবি, বল। আমার সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাজ আছে একটা। ভার্সিটিতে থাকবো। নটায় আসবি?
আসবো। ঠিক সাড়ে নটায় আসবো। ছাদে থাকবি।
ঠিক আছে, থাকবো। চলে আয়। আর শোন।
কী?
যা-ই হোক, মনে রাখিস, আমি কিন্তু সবসময় আছি, তোর পাশে ।
জানি তো। – ছোট্ট করে উত্তর দেয় তুবা।
ভালো থাকিস। ছাড়ছি রে। বাই।
বাই।

কলটা কেটে যেতেও অনেকক্ষন হাতে নিয়ে বসে রইলো তুবা। আফ্রাকে কী বলবে ও? কিভাবে বলবে? নিজের ভেতরের ঘুনপোকাটাকে আটকেই তো রেখেছিল ও। এখন সেটা কালকেউটের বাসা বানাতে চাইছে মিরাজ। ওকে আফ্রার মতো হতে বলে প্রতিদিন, ওইরকম পোষাক, কার্লি চুল। আহ্! প্রতিদিন একইভাবে মরে যাওয়াটা কী ভয়ংকর মিরাজকে ছেড়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই ওর। কে আছে দুনিয়ায়? পড়ালেখাটাও যদি শেষ করতে পারতো। মিরাজকে দোষী বানাতে অবচেতন মনই চাইছে না। আফ্রারও তো কোন ভূমিকা নেই এখানে। তুবা নিজেকে অভিশাপ দিতে শুরু করে এবার। ওর মনে হয়, ও আসলে আফ্রার তুলনায় কত সাধারণ, অনাকর্ষণীয়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, যদি আফ্রার সাথে পরিচয়টাই না হতো।

তুবার ফোনটা রাখার পর আফ্রা অনেকক্ষন ধরে ভাবল, তুবার কী হতে পারে। এইটুকু অন্তত বুঝতে পারাই যায় যে, সমস্যাটা ওদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে। মিরাজ কি কোন কিছুতে জড়িয়েছে? অন্য কোন মেয়ে? নাকি তুবা কাউকে মন দিয়ে ফেলেছে? কিন্তু তাহলে তুবা ওর কথা বললো কেন? ভেবে ভেবে কোন কুলকিনারা পেল না আফ্রা।

সেদিন রাতেরবেলা দুই বান্ধবীর দেখা হলো অনেকদিন পর৷ পার্থক্য কেবল, সেই হাসিখুশি আড্ডার মেজাজটা নেই। একজনের মনে বিষন্নতার পাথর ভারী হয়ে আছে। আর আরেকজনের মন অসীম কৌতুহলে টগবগ করে ফুটছে।

এবার বল, কী হয়েছে। কিচ্ছু লুকাবি না কিন্তু তুবা।

তুবা যেন এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিল। একে একে বলে যায় মিরাজের সাথে ওর সংসার জীবনের কথা। স্বামী স্ত্রীর ওই খুব বিশেষ ব্যাপারটায় মিরাজের অস্বাভাবিক আচরণের কথা, যেটা কিনা বিয়ের পর থেকেই তুবাকে সহ্য করে যেতে হচ্ছে।

সবশেষে আফ্রাকে নিয়ে মিরাজের বলা ফ্যান্টাসিগুলো আর সেটাকে কিভাবে প্রতি রাতে তুবাকে বাধ্য করে শুনতে, সেভাবে আচরণ করতে, সেটা বলতে গিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় তুবা হেঁচকি তুলতে শুরু করে। ঝরঝর করে পানি ঝরে পড়ছে দুচোখ দিয়ে। আফ্রা পাথরের মুর্তির মতো বসে৷ কী শুনছে ও এইসব? কী বলবে ও তুবাকে? একটা মেয়েকে এই অবস্থায় কী বলা যায়? আফ্রার মাথাতেই আসছে না, কিভাবে দিনের পর দিন তুবা এইসব সহ্য করে যাচ্ছে।
আফ্রা দুহাতে জড়িয়ে ধরতে গেল তুবাকে, সেই ছোট্টবেলার মতো। যেন স্পর্ষ দিয়ে মুছে নেবে বন্ধুর সবটুকু কষ্ট। মিরাজের নামটা মনে হতেই ওর মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। এরকম বিকৃত একটা মানুষের সাথে এই ফুলের মতো নরমসরম মেয়েটা এতোদিন নরক যন্ত্রনায় জ্বলছে, আফ্রা সহ্য করতে পারছে না আর। তুবা দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ওভাবেই চুপ করে গিয়েছে কথাগুলো বলে। আফ্রা পরম মমতায় ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই তুবা ছটফটিয়ে উঠল। যেন গায়ে কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে ওর। দু হাতে ঠেলে সরিয়ে দিল আফ্রাকে, ‘আমাকে ছেড়ে দে তুই। আমার আর কিচ্ছু নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ তুবা এগিয়ে যেতে চায় ছাদের কিনারার দিকে। এই নামহীন নরকের জীবন রেখে কী লাভ?

অন্যসময় হলে আফ্রা তুবাকে ছাড়তো না কিছুতেই। কিন্তু মনের ক্লেদের স্লুইস গেটটা খুলে যেতেই সেই ধাক্কাটা হয়ে গিয়েছিল মাত্রাছাড়া। পুরোনো রেলিংটা ভেঙ্গে একটা আর্তচিৎকারের সাথে আফ্রা যখন নিচে পড়ে যাচ্ছিল, তখন ওর দেখা শেষ দৃশ্যটা তুবার দু চোখ – তাতে প্রচন্ড কষ্ট আর সব হারানোর হতাশার সাথে কোথায় যেন খুব আবছা করে উঁকি মারছিল অন্য একটা অনুভূতি।

 

পরিশিষ্ট.

সব গল্পের পরিশিষ্ট থাকতেই হবে, তেমনটা নয়। সবকিছু প্রতিদিনকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপারগুলোর মতো ব্যাখ্যা করা যাবে, তা-ও নয়। অনেকগুলো ‘যদি’, ‘হয়তো’ আর ‘কিন্তু’ লুকিয়ে থাকে বন্ধ জানালাটার ওই পাশটাতে। তুবা, ইফতি, মিরাজ – প্রত্যেকেই নিজের জানালাটার ওপাশে বন্দী হয়ে আছে। হতে পারে সেটা কোন মেন্টাল অ্যাসাইলাম। হতে পারে সেটা কোন সলিটারি সেল। আবার হতেও পারে একা অথবা অন্য কারও সাথে ভাগ করে নেয়া কোন বেডরুম। তিনজন মানুষ আর তিনটা জানালা নিয়ে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার কম্বিনেশন বানানো যায়? গনিতের হিসেবে হয়তো অল্প কটা কিন্তু জীবনের হিসেব? অগুনিত।

প্রায় আট মাস কেটে গিয়েছে ওই ঘটনাটার পর। সময়ের ফ্রেমে আটকে থাকা জুম্মান কোচওয়ান লেন বদলে গিয়েছে অসম্ভব রকমের৷ সরাফ সাহেব বিক্রি করে দিয়েছেন বাড়িটা। চলে গিয়েছেন এলাকা ছেড়ে নিজের গ্রামে। পুরোনো ভাড়াটেদের মধ্যেও প্রায় কেউই নেই। গলিটায় আসলে প্রাণটাই আর নেই আফ্রা চলে যাওয়ার পর। নেই তুবা, মিরাজ বা ইফতিও। অনেকদিন পর তুবাদের ছেড়ে যাওয়া বাসাটায় একটা তরুণ দম্পতি উঠেছিল। মেয়েটা একদম অল্প বয়সী, নাম শাহানা। ওর স্বামীটাও চব্বিশের বেশি হবে না। মেয়েটা এক রাতে রান্না করছিল এক মনে। ডালটা অনেকটা ফুটে উঠতে তাড়াতাড়ি কাঠের হাতাটা নেওয়ার জন্য জানানার পাশে রাখা স্ট্যান্ডে হাত বাড়ায় এবং সেখানেই জমে যায়। জানালার আবছা অন্ধকারের ফ্রেমে একটা অবয়ব ঝুলে আছে, কোঁকড়া চুলের একটা মেয়ে, যার মাথায় হলদে একটা হেয়ারব্যান্ড আলগা করে লাগানো। মায়াময় মুখটা কিছু যেন বলতে চাইছে। কিন্তু গাঢ় তরলে ভেসে যাওয়া ঠোঁটদুটো কেবল নড়ছে, আওয়াজ হচ্ছে না কোন

শাহানা একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর হুলুস্থুল কান্ড। সবাই এক সময় ধরে নেয়, কি দেখতে কি দেখেছে। শাহানা যেহেতু অন্তঃস্বত্তা, তাই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় খুব। আফ্রার কাহিনী তো এই লেনের সবাইই জানে। মেয়েদের এই অবস্থায় মনের মধ্যে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। শাহানার স্বামী জানালাটা বন্ধ করে দেয় এরপর। এরও এক মাস পর ওরা চলে যায় বাড়িটা ছেড়ে। কারণ শাহানার সবসময়ই মনে হতো, জানালার ওপাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। খুব করে কিছু একটা যেন বলতে চায়। কিন্তু বন্ধ জানালায় তার অতৃপ্ত নিঃশ্বাস ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় শুধু।

জানালাটা তাই আর খোলা হয় না। চেষ্টাও করেনি এরপর কেউ আর কখনও। জানালা কখনও আকাশ দেখায়, কখনও হু হু হাওয়া চুল ওড়াতে আসে, আবার কখনও খুব প্রিয় কারও ফেলে যাওয়া শব্দরা ফিস ফিস করে উড়ে উড়ে আসে – আমি তো ছিলাম। আমিও তো থাকতে পারতাম। সেই তিনজন মানুষ এখন তিনটি আলাদা আলাদা জানালায় তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। আর ভাবে, সেই ময়ুরকন্ঠী রাতটায় যদি…। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনে তিনটা ভিন্ন স্লাইড শো ওদের চোখের সামনে ছায়াছবির মত চলতে শুরু করে এরপর। কোনটা যে সত্যি, সেটা তিনজনের কেউই কি জানে? শুধু ঝিম ধরা মধ্য দুপুরে কখনও কখনও কোন বাড়ির ছিটকিনি খোলা জানালার কবাট শব্দ তোলে নিরুদ্দেশ বাতাসে।

কোন কোন ময়ুরকন্ঠী রাতে এমন কিছু জানালা খুলে যায়, আবার বন্ধও হয়ে যায়। তার খবর কেউ রাখে না। শুধু জানালাগুলোই লুকিয়ে রাখে তাদের গল্পগুলো।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
মরিচিকা অভিলাস

মরিচিকা অভিলাস

দীপঙ্কর শীল   তুমি যদি এসো  নিদ্রালু নয়ন জেগে থাকবে, হৃদয় পরশে ঝরবে প্রেমবৃষ্টি যদি শুরু হয় এলোমেলো ঝড়, তবু মেঘজলে ভিজে পাশে রহিবে।   ...
বাংলা রোমান্টিক প্রেমের গল্প - অপরাজিতা তুমি (অডিও)

বাংলা রোমান্টিক প্রেমের গল্প – অপরাজিতা তুমি (অডিও)

ছাইলিপির গল্পপাঠ সেগমেন্টে আমাদের আয়োজন….অপরাজিতা তুমি। গল্পটি লিখেছেন…আশিক মাহমুদ রিয়াদ।
দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস

দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস

আবির ইসলাম ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত কেন্ট কাউন্টির(বিভাগ) একটি ঐতিহ্যবাহী শহর ক্যান্টারবেরি। শহরটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজি সাহিত্যের জনক হিসেবে খ্যাত মধ্যযুগীয় লেখক ...
ছোট গল্প - বাপের বাড়ি

ছোট গল্প – বাপের বাড়ি

ডঃ গৌতম সরকার গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এসে চিতার আগুনটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এদিকটায় কোনো আলো নেই। দূরে ডোমের এক কুঠুরি ঘরটায় একটা অল্প পাওয়ারের ...
নেগিটিভ মার্কেটিং কি? এর সুবিধা - অসুবিধা (Pepsi vs Coca-Cola)

নেগিটিভ মার্কেটিং কি? এর সুবিধা – অসুবিধা (Pepsi vs Coca-Cola)

ছাইলিপি ডেস্ক নেতিবাচক বিপণন, যা “আক্রমণ বিজ্ঞাপন” নামেও পরিচিত, একটি বিপণন কৌশল যা একটি প্রতিযোগীর অফারকে হেয় করার মাধ্যমে একটি পণ্য বা পরিষেবার প্রচারের সাথে ...
বঞ্চিত চিত্রকরদের নতুন ছবি- মহীতোষ গায়েন

বঞ্চিত চিত্রকরদের নতুন ছবি- মহীতোষ গায়েন

 মহীতোষ গায়েন রংতুলি সব হারিয়ে গেছে তবুও কষ্ট এঁকেছি চিত্রপটে,সব দু:খগুলো একটু একটু করে রঙিন হবে,তারপর একদিন নিলাম হবে,চড়া দরে বিকোবে চিত্রপট। আস্তিন গুটিয়ে নিয়েছে ...