গৌতম সরকার
কালো রঙের বি.এম.ডব্লিউ গাড়িটা এয়ারপোর্ট এক নম্বরে এসে দাঁড়ালো। কলকাতার লোকের কাছে এসব গাড়ি অনেকদিন চোখ সয়ে গেছে, তবুও গাড়িটা উপস্থিত অনেকেরই চোখ টানলো। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে বের হলেন বছর বাইশ-তেইশের এক তরুণী, বিদেশিনী। কৌতূহলটা গাড়িকে নিয়ে নয়, এই তরুণীকে ঘিরে। মেয়েটির পরনে যদিও সাদাসিধা পোশাক, অনুজ্জ্বল চুড়িদার, গায়ে একটা সবুজ রঙের হাফ জ্যাকেট, পায়ে স্নিকার। কাঁধে একটা ব্যাকপ্যাক, হাতে পার্স। বাহুল্যবর্জিত মেয়েটির চেহারায় প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সেটি হল ওর গভীর চোখ, ঘন আঁখি পল্লব আর বাদামী আইরিশ। মেয়েটি নেমে দাঁড়াতেই গাড়িটা হুশ করে বিরাটির দিকে চলে গেল। মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অনেক লোকের আকর্ষণের মাঝে পড়ে গেলে কি করতে হয় ও জানে। ওদের প্রশিক্ষণের মূল শিক্ষা হল, বহুজনের মধ্যে মিশে যাওয়া, কোনোভাবেই বিশেষ জন হয়ে থাকা নয়। মেয়েটি আশপাশ তাকিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। আশপাশের লোকজন যারা কাজকর্ম ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, তারা সম্বিত ফিরে পেয়ে তড়িঘড়ি নিজের কাজে চলে গেল। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে দোকানদারকে ইশারা করে এককাপ চা চাইল। দোকানের অন্য খদ্দেররা আড়চোখে ব্যাপারটা দেখে নিজেদের গল্প-আড্ডায় ফিরে গেল। চা খেয়ে পয়সা মিটিয়ে ধীরে সুস্থে হেঁটে চলল তিনমাথার দিকে। খেয়াল করল এখন তার দিকে কেউ তেমনভাবে নজর করছে না৷ এবার একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরতে হবে।
চার বছরের তাতুনসোনা জীবনে আজ প্রথম হাওয়াই জাহাজ চড়বে, তাই তার আনন্দের সীমা নেই। তার ওপর প্লেনে চড়ে যাবে দাদাই-দিদানের বাড়ি, যে বাড়িটাকে সে নিজের বাড়ির চেয়েও ভালোবাসে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে বাবা-মার সাথে সে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। এসেই তার চক্ষু চড়কগাছ। কি বিশাল! আর কি পরিষ্কার! চারদিক ঝক ঝক করছে। চারপাশে কত সুন্দর সুন্দর মানুষ যাতায়াত করছে। তাদের পোশাক, কথাবার্তা, চালচলন কোনোটাই বাবা-মায়ের সাথে মেলেনা। তাতুনের চোখ চলে যায় একদম কোনের চেয়ারটায় বসা একটা দিদির দিকে। কি সুন্দর দেখতে! একমাথা ঘন কোঁকড়া চুল, আর চোখের মণি দুটো বাদামী। কিন্তু মণি দুটোয় যেন কিছু একটা আছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভয় ভয় লাগে। তবে তাতুনসোনার বেশিক্ষণ মানুষ দেখা হলনা। মা তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল সিকিউরিটি কাউন্টারের দিকে। সিকিউরিটি চেকে যে পুলিশ আন্টিটা ওর গা-হাত টিপে টিপে দেখছিল, তখন বেশ কাতুকুতু লাগছিল। সে হেঁসে ফেলাতে আন্টিটাও হেঁসে ওর গালে টিপে দিয়েছিল।
মোবাইলের কোড বলছে মিরান এখন রাস্তায়। ওর অফিসে পৌঁছতে আরো মিনিট পনের লাগবে। মোবাইল বন্ধ করে ব্যাকপ্যাক নিয়ে অলস ভঙ্গিতে সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে পৌঁছল। অনেক সময় বাকি, বোয়িং এসজে-৭৮৩ ছাড়তে এখনও দু ঘন্টা দেরি। মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল, নির্দেশ এল সিকিউরিটি চেকিং সেরে ফেলার। দু-মিনিটের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটে গেল। ভেতরে ঢুকে নির্দিষ্ট গেটের কাছে চলে গিয়ে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসতেই বাচ্ছাটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।
বিজ্ঞান যত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে সমগতিতে ছুটছে প্রযুক্তি। ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে বিজ্ঞানকে ফাঁকি দিতে বিজ্ঞানেরই সাহায্য নিয়ে নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার হচ্ছে। এই যে সিকিউরিটি পয়েন্টের স্ক্যানিং মেশিনগুলো, শরীরের হাড়-মাংস ভেদ করার ক্ষমতা আছে। অথচ তার শরীরে অপারেশন করে ঢোকানো হাইড্রোজেন বোমাগুলো কি স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ল! এই অপারেশনে যখন সে সিলেক্টেড হল, তখন ডাক্তারবাবুকে এই প্রশ্নটাই করেছিল। তার উত্তরে ডাক্তার বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদীদের কাছে এমন কিছু মেটেরিয়ালের সন্ধান আছে, যেগুলো ভেদ করার ক্ষমতা কোনো স্ক্যানিং বা এক্সরে ডিভাইসের নেই। সেই সব মেটেরিয়ালের অস্তিত্ব বাকি দুনিয়ায় কাছে নেই। সেরকম কোনো এক ধাতুর মোটা দেওয়ালের ভিতর যত্ন করে ঢোকানো আছে পাঁচটা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন হাইড্রোজেন বোমা। যার বিস্ফোরণ একটা গোটা প্লেনের সবকিছুকে খোলামকুচির মত টুকরো টুকরো করে ফেলবে। তবে ওগুলোর জন্য জায়গা করতে শাহিকার শরীর থেকে বেশ কিছু অঙ্গ ছাঁটকাট করতে হয়েছে। অর্থাৎ যে অঙ্গগুলো পুরোটা বা আংশিক না থাকলেও মানুষ পনেরো-থেকে তিরিশ দিন বেঁচে থাকতে পারে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। শাহিকার অপারেশন শেষ হয়েছে দিন দশ আগে। এখনও সে বেশ দুর্বল, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী দশ দিনের মাথায় ফার্স্ট অ্যাটেম্পট নিতে হবে, অসফল হলে আবার দশদিন পর সেকেন্ড অ্যাটেম্পট, এভাবে তিনটে চান্স পাওয়া যায়। শাহিকার দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রথম অ্যাটেম্পটেই সফল হবে। জেড-এক্স কোড জানান দিল মিরান কম্পিউটার ওপেন করল।
বাচ্চাটা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাঁসল। শাহিকার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওর ভাইয়ার মেয়ের মুখ। কতদিন দেখেনি, তার মুখের আধো আধো স্বরে ‘ফুফি’, ‘ফুফু’ ডাক শোনেনি। চোখের কোনটা চিনচিন করে উঠতেই সচেতন হয়ে উঠল। ওদের জেহাদি ট্রেনিং সেন্টারে টাফ ক্যাডার হিসেবে তার নাম ছিল একদম ওপরের দিকে। কিন্তু ট্রেনার সাবদের কাছ থেকে যে কারণে প্রচুর বকুনি খেতে হয়েছে সেটা হল ওর নরম মন। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর শীতের রাতে কম্বলের ভিতরে মুখ লুকিয়ে আব্বা-আম্মির জন্যে কতদিন কেঁদেছে। আর যেদিন যেদিন কাঁদতো, পরেরদিন কোনো না কোনো ট্রেনার ঠিক ধরে ফেলত। বাচ্চাটা এখন বাবা-মায়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ওকে উঁকি মেরে দেখছে। শাহিকার খুব মজা লাগল। ও এমন ভাব করল যেন বাচ্ছাটাকে দেখছেনা, তখন বাচ্চাটা সাহস করে ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, ঠিক তখনই চমকে দিয়ে চোখে চোখ ফেলতেই বাচ্চাটা ভীষণ লজ্জা পেয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকোলো। মা ভদ্রমহিলা কি হল বুঝতে না পেরে পিছন ফিরতেই শাহিকার সাথে চোখাচোখি। শাহিকা মুচকি হাঁসল, ভদ্রমহিলা প্রথমে একটু থতমত খেলেও মৃদু হেঁসে প্রত্যুত্তর দিলেন।
ট্রেনিংয়ে একটা জিনিস শিখতে হত, নিঃশ্বাস বন্ধ করে কে কতক্ষণ থাকতে পারে তার প্রশিক্ষণ৷ যেকোনো অপারেশনের সময় এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে যেখানে অক্সিজেনের ঘাটতি আছে, সেটা কোনো রুখুশুখু পাহাড়ি এলাকা হতে পারে, এয়ারটাইট কক্ষ বা চেম্বার হতে পারে, বা বিমানের মত যান হতে পারে যেখানে অপারেশনের সময় এসি লাইন বিগড়ে গেলে যাতে জেহাদীরা বেশ কিছুক্ষণ টিকে থাকতে পারে। শাহিকা এই ট্রেনিংয়ে সবসময় প্রথম হত, তার কারণ ছিল তার জন্মভূমি। প্রত্যন্ত একটা পাহাড়ি গ্রাম, মাত্র চল্লিশঘর মানুষের বাস। গাছপালাহীন রুক্ষ প্রান্তরে সারা বছর ধরে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। মাটির ঘরের ফাঁকফোকর খুঁজে ঘরের ভিতরে ঢুকে থাকা মানুষগুলোকেও সময়ে সময়ে কাঁপিয়ে দেয়। গ্রামে কোনো স্কুল ছিলনা, তাই সাত ভাইয়ের বোন শাহিকার লেখাপড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু দাদাদের একে একে শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়া তাকে পীড়িত করতো। বহু কান্নাকাটি, রাগ-অভিমান করেও বাবা-মায়ের মন গলাতে পারেনি। তারপর যখন ষোলো বছর বয়সে তার নিকাহের ব্যবস্থা শুরু হল তখন সে বাড়ি থেকে পালালো। তারপর গত ছয় বছরে তার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে, এখন সে দলের গ্রেড ওয়ান ক্যাডার। সেকারণেই সেই সুদূর আফগানিস্তান থেকে কলকাতার বুকে অপারেশন চালাতে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে তার সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষতম দিনে তার জন্মভূমি সূদুর আফগানিস্তানের ‘গরমাব ওলিয়ার’ জন্যে কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে ভাসছে আব্বু, আম্মু, ভাইয়া-ভাবীদের মুখ, আর বড় ভাইয়ার মেয়ে জুবেদার মুখটা মনে পড়তেই চোখের কোনদুটো ভিজে উঠল। এবার আর চমকালোনা, নিজেকে ধমকও দিলোনা। এখানে কে আর তাকে দেখতে যাচ্ছে! আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা! সে বাচ্ছাটাকে খোঁজার চেষ্টা করল, দেখতে পেল ওরা যেখানে বসে ছিল সে জায়গাটা খালি।
এবার মোবাইলের দিকে চোখ ফেরালো। বারকোডে নিজের এনট্রপি পাসওয়ার্ড দিতেই একের পর এক নির্দেশ আসতে লাগল। মনিটর ওপেন করতে চারটে ব্লগ খুলে গেল। ভিডিও বাটন চাপ দিতেই চারটে ক্যামেরা অন হল। মিরান ছাড়াও অক্টাভিও, নীরজ আর আয়েশাকে দেখতে পেল। চারটে চ্যানেল থেকে এনট্রপি অ্যাড্রেসে প্রসেসিং শুরু হয়ে গেছে। এটা সাধারণত মূল অপারেশনের একঘন্টা আগে থেকে শুরু হয়। পৃথিবীর এক কোণে রিমোট টেপা হবে আর অন্য কোণে ব্লাস্ট হবে। পদ্ধতিটিতে খুব জটিল গণিত রয়েছে। এছাড়া আরও অনেক অনেক কোড-আনকোড, জিওমেট্রিক স্ট্রাকচার, তারপর সঠিক সিগনাল পাকড়াও করে সিংক্রোনাইজ সিস্টেমে ফেলে সঠিক ওয়েভলেনথ মিলিয়ে ঠিকঠাক জায়গায় চার্জ করা, এগুলো শাহিকার ক্ষুদ্র মাথায় ঢোকার কথা নয়, সে চেষ্টাও কখনও করেনি। সে শুধু দেখে যাচ্ছে তার এনট্রপি অ্যাড্রেসে কি নির্দেশ আসছে। একবার ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার, ব্যাগপত্র গুছিয়ে উঠতে যেতেই কিসের সাথে ধাক্কা লেগে পার্সটা পড়ে গেল। যার সাথে ধাক্কা লেগেছে সেও চিৎপটাং। চটপট নিচু হয়ে তুলতে যেতেই পেটের মধ্যে যেন কেউ ছুরি চালিয়ে ফালা ফালা করে দিল। অসহ্য যন্ত্রণায় চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল শাহিকার। পেটের মধ্যে যে নলটা ঢোকানো আছে তার জন্য অপারেশনের পর নিচু হতে পারেনা। বাচ্ছাটা পড়ে যেতে সব ভুলে নিচু হয়ে তুলতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ওদিক থেকে বাচ্ছাটার মা দৌড়ে এসে মেয়েকে তুলে নেয়। শাহিকা কোনোরকমে ‘স্যরি’ বলে। বাচ্ছাটার মায়ের দৃষ্টি থেকে শাহিকা নিজের যন্ত্রণাকাতর মুখের অভিব্যক্তি লুকোতে পারেনি। মেয়েকে কোলে তুলে উদ্বিগ্ন চোখে প্রশ্ন করেন, ‘আপকা তবিয়ত ঠিক হ্যায় না!’ শাহিকা তখন নিজেকে সামলে নিয়েছে। ‘ইটস ওকে, থ্যাংকিউ ম্যাম’ বলে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ায়।
অপারেশনে বাঁদিকের কিডনি পুরো বাদ গেছে, ডানদিকেরটাও কিছুটা বাদ দিতে হয়েছে। ফলে ওর শরীরে স্বাভাবিক ভাবে ইউরিন পাস করতে পারেনা। তলপেটে ফুটো করে একটা চ্যানেল করে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে বাথরুম করতে অনেকটাই সময় লাগে। ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে দেখল বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ি বলছে অপারেশন হতে ঠিক আধা ঘন্টা বাকি। প্রথমে ঠিক ছিল অপারেশন হবে মাঝ আকাশে, পরে পরিকল্পনা বদলানো হয়েছে। মাঝ আকাশে ব্লাস্ট হলে ফ্লাইটের লোকজন ছাড়া ব্যাপারটার ভয়াবহতা আর কেউ টের পাবেনা, কিন্তু রানওয়েতে হলে একটা গোটা এয়াপোর্ট ভর্তি লোকজন কেঁপে উঠবে। সন্ত্রাস আর ভয় ব্যাপারটা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া যাবে, যেটা যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের মূল লক্ষ্য৷
পায়ে পায়ে এগোতে দূরে বাচ্চাটাকে আর তার মা-বাবাকে দেখতে পেল। বাচ্ছাটা তাকে হাত নেড়ে ডাকছে, আর পাশে বাবা-মা হাঁসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহিকা প্রমাদ গণল। শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু জরুরি নির্দেশ আসবে, সেইসময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আল্লার কাছে শেষ মুহূর্তে দোয়া কবুল করতে হবে। কাছে যেতে বাচ্চাটার মা বলল, “মেরি লেড়কি তো আপকি ফ্যান বন গয়ি হ্যায়। আপকি বিনা উও বোর্ডিং নেহি করেগি বোল রাহি হ্যায়। দিদি কো আনে দো, দিদি কো আনে দো….ইয়ে হি জিদ পকর কে বৈঠি হ্যায়।” শাহিকা মিষ্টি করে হাঁসে, আর তার হাঁসি দেখে বাচ্ছাটা ছুটে এসে ওর দুটো পা জড়িয়ে ধরে। শাহিকা তাড়াতাড়ি ওকে ধরতেই ও মুখ তুলে শাহিকার দিকে চাইলো। ওর দুচোখে সবুজ সমুদ্রের পাগল হাতছানি। ততক্ষণে ওরা বোর্ডিংয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, বাচ্ছাটার বাবা-মা সামনে, আর বাচ্ছাটাকে নিয়ে শাহিকা পিছনে। বাচ্ছাটা নিজের ভাষায় শাহিকার দিকে তাকিয়ে অজস্র কথা বলে যাচ্ছে। একজন টাফ ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও শাহিকার বুক কেঁপে উঠল। বাচ্ছাটার চোখে চোখ পড়তেই তার জগৎসংসার ওলটপালট হয়ে গেল, চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ধূসর, রুক্ষ পাহাড়তলি, আর সেই পাহাড়তলির সংকীর্ণ উৎরাই ধরে ‘ফুফি, ফুফি’ ডাকতে ডাকতে টলমল পায়ে ছুটে আসছে জুবেদা। যেকোনো মুহূর্তে টাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেলেই গহীন খাদে তলিয়ে যাবে৷ শাহিকা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। লাইনে দাঁড়ানো যাদের কানে চিৎকারটা পৌঁছল তারা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে দেখল। বাচ্ছাটার মা কি এক আতঙ্কে মেয়েকে আঁকড়ে ধরল। তার মুখে একরাশ জিজ্ঞাসা…বাচ্চাটা মায়ের হাত সরিয়ে দুহাত দিয়ে শাহিকার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ উঁচু করে শাহিকার মুখের দিকে তাকালো। অতটুকু বাচ্চাও বুঝেছে দিদি কোনো কারণে ভয় পেয়েছে। ও ছোট ছোট আঙুলে শাহিকার আঙুল স্পর্শ করল। মোবাইল সিগনাল দিচ্ছে আর ঠিক দশ মিনিট। তারপর…বাচ্ছাটা কিছুতেই ছাড়ছেনা। হঠাৎ কানে ভেসে এল জুবেদার প্রাণভোলানো হাঁসি, আর মধুমাখা ‘ফুফা’, ‘ফিফি’ ডাক। শাহিকা বাচ্চাটার হাত ছাড়িয়ে দুটো হাত কানে চেপে জোর করে সেই হাঁসির আওয়াজ বন্ধ করতে চাইল। বাচ্ছাটা সাময়িক থতমত খেয়ে আমার ছোট ছোট হাতের নিবিড় বেষ্টনে কোমর জড়িয়ে ধরল। শাহিকা আর কিছু ভাবতে পারলোনা। তার এতদিনকার শিক্ষা, ট্রেনিং, বিশ্বাস সবকিছু মুহূর্তের ভূমিকম্পে টলে গেল। সবকিছু ভুলে বাচ্চাটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে পিছন ফিরে দৌড় মারলো।
কি হল কেউ বুঝে ওঠার আগেই সামরিক ট্রেনিং কাজে লাগিয়ে একটা অবিশ্বাস্য স্প্রিন্ট টানল, লম্বা করিডোর পেরিয়ে সিকিউরিটি টেবিলের সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুটো স্প্রিংবোর্ড ডাইভ দিয়ে সবাইয়ের নাগালের বাইরে পৌঁছে গেল। তারপর আবার দৌড়। মোবাইল বলছে আর ঠিক দু মিনিট। অগণিত নারী-পুরুষ, বাচ্ছা-বুড়োকে ডজ করতে করতে যখন এক্সিট গেটে পৌঁছল তখন পিছনে ভয়ানক চিৎকার। সিকিউরিটি অ্যালার্ট হয়ে গেছে, যদিও কারণ কেউ জানেনা। শাহিকার ভাবার সময় নেই, গেটের হতভম্ব লোকগুলোর নাগাল পেরিয়ে যখন খোলা আকাশের নিচে পৌঁছল তখন মিরানের হাতে রিমোট উঠে এসেছে। শাহিকাকে ওপাশ থেকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। মিরান যন্ত্রবৎ কাজ করে চলেছে। তিরিশ সেকেন্ডে প্রায় দেড়শো মিটার স্প্রিন্ট টেনে শাহিকা যেখানে পৌঁছল সেখানে আশপাশে কয়েকটা কুকুর আর একটা ভিখারী ছাড়া কেউ নেই। প্রচন্ড আওয়াজে সারা এয়ারপোর্ট কাঁপিয়ে বিস্ফোরণ হল। কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল সমগ্র এলাকা। তীব্র গতিতে ছিটকে যাওয়া স্প্লিন্টারের আঘাতে আশপাশের দেওয়াল ভেঙে পড়ল, কয়েকটা গাছ স্রেফ ভস্মীভূত হয়ে কালো অঙ্গার কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ওপর ভয়ার্ত পাখিগুলোর আর্ত আওয়াজ ছাড়া গোটা এয়ারপোর্ট একেবারে শব্দহীন। মানুষ আর কুকুরের পোড়া মাংসের গন্ধে বাতাস ক্রমশ ভারী করে উঠতে লাগল।
রানওয়েতে এসজে-৭৮৩ টেক অফের জন্য প্রস্তুত। দৌড় শুরু করেছে। জানলার ধারে বসা একটা বাচ্ছা মেয়ের মুখভার, চোখের কোনে জল। কারোর সাথে কথা বলছেনা। জলভরা চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। প্লেনে ওঠার পরে অনেকক্ষণ সে দিদির জন্যে অপেক্ষা করেছিল।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।