জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথ এবং কলকাতা পুলিশের একটি তদন্ত

জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথ এবং কলকাতা পুলিশের একটি তদন্ত

 মিরাজুল  হক 

লালবাজার। কলকাতা পুলিশের হেড কোয়াটার। একটি অভিযোগ জানিয়েছেন মনজুশ্রী দাশ। কবি জীবনানন্দ দাশের মেয়ে। সময়টা সেপ্টেম্বর , ১৯৮০। মনজুশ্রী দাশ মেচেদা থেকে লোকাল ট্রেনে হাওড়া ফিরছিলেন । ট্রেনের বসার সিটের তলায় রাখা সুটকেসেই  জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল । অনেক খাতা ছিল । হাওড়া স্টেশনে যখন নামেন , তখন দেখেন যে সুটকেসটি নেই । চোর ভেবেছিল অনেক টাকা পয়সা বা গহনা আছে । কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান শ্রী প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায় ,   নিজে দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত শুরু করলেন । কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় ,  পুরনো এক বইয়ের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল কয়েকটি খাতা । তাও সবটা  নয় । তদন্তের সুত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে গিয়েছিল বইপাড়ার এক মুদিখানার দোকানে । হারানো খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তৈরি ঠোঙায় সর্ষে বিক্রি করছেন দোকানদার । সাত কিলো ওজনের খাতাপ্ত্র কিনেছিলেন সাড়ে বার টাকায় । 

কবি জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির বেশকিছু বাক্স করে আর ফেরত আনা যায় নি । হারিয়ে গেছে । চিরদিনের মতো হারিয়েগেছে কবির কল্পনার শব্দ-বিস্ময় । রূপসী বাংলা । বাংলা কবিতার নির্জনতম সৌন্দর্য । অপার্থিব শব্দ সম্ভার ।  তাঁর মৃত্যুর ৬৬ তম কাত্তিকের পরেও ,  তিনিই বাংলা ভাষার শক্তিশালী  কবি । শুধু দুই বাংলার নয় । পৃথিবী জুড়ে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে  রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি । অথচ জীবদ্দশায় এই স্বীকৃতি কবি পান নি ।  জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরেই , বুদ্ধদেব বসু একটি স্মরণ সংখ্যা প্রকাশ করার জন্য কবি সুধিন্দ্রনাথ দত্তের কাছে লেখা চেয়েছিলেন । সুধিন দত্ত বলেছিলেন , যিনি কবি নন তাঁর জন্য স্মরণ সংখ্যা করবার কি দরকার ! 

মার্কিন লেখক ক্লিনটন বি সিলি বলেছেন রবীন্দ্রনাথের পর বাংলার শ্রেষ্ঠ  পোয়েট । ‘ বনলতা সেন ‘ পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হিসাবে স্বীকৃত , মূল্যায়িত । পাখির নীড়ের মতো চোখ , নিশার মতো চুলরাশি । প্রেমিক হারিয়ে যায় অনেকবার অনলান্ত অন্ধকারের গহ্বরে । অনেক দীর্ঘ পথ হেঁটে ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে , পথিক  জল পেলে যেমন শান্তি পায় , তেমনি বনলতার কণ্ঠস্বরে – ‘ এত দিন কোথায় ছিলেন …’  শব্দ চিত্র কল্পনা আশা আকাঙ্খা বেদনা বিহ্বলতায়  শূন্যতার সৌন্দর্যের জন্য ,  জীবনানন্দ দাশ আধুনিক । অতি আধুনিক । অস্পষ্ট , নির্জনতম , দুর্ভেদ্য , পরাবাস্তব – কত বিশেষণ । বাংলা কে রূপসী করে তোলার জন্য তাঁর জুড়ি নেই । তিনি অনন্য , অদ্বিতীয় ।  রূপসী বাংলার  অবারিত মাঠ আর ঘাস ।  আকাশ নদী নালা সূর্য ছায়া নীরবতা অন্ধকার নিশিরাত  – এই সব সৌন্দর্য তাঁর কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে । আবার এই সবের চারপাশে আছে একটা অনিশ্চয়তা । অসফল মানুষ , বেকার লাথি খাওয়া মানুষ ।  দুঃসহ বেকারত্বের দিন । কলকাতার মেসজীবন । চাকরী খুঁজে ফেরা । চাকরী না -পেয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা  । এই সব কিছু থেকে কি মুক্ত হতে পরেছিলেন – 

“ হায় চিল , সোনালি ডানার চিল 

   তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে 

   তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের তার ম্লান চোখ মনে  আসে 

   পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে …”  

বরিশাল । ধানসিঁড়ি নদীতে স্টিমারের যাওয়া আসা । জলের ছলাত ছলাত শব্দ । চারদিকে গাছ , মাথার উপরে গাছ , সামনে গাছ । পায়ের নীচে পাতার স্তূপ । জাম , কাঁঠাল , হিজলের , অশথের অপূর্ব স্থান । শালিক , গঙ্গাফড়িইং , শ্যামা পোকার গুঞ্জনের ভিতরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া । পুকুর পাড়ে হাঁসেদের , পুকুরে ঘাটে  কিশোরীর হাতে চাল ধোয়ার ঘ্রান । কবি হেঁটে যান কীর্তনখোলার  ( বরিশাল )  পাশ দিয়ে । তাকিয়ে দেখেছেন লাশকাটা ঘরটাকে । বড় অযত্নে লাশকাটা ঘরের চিত্রও কবির ভাবনায় । কবির লেখাপড়ার হাতেখড়ি  তাঁর মায়ের কাছে । কুসুমকুমারী দাশ । আটপৌরে মলিন শাড়িতে সংসারের কাজ সামলাতেই সারাদিন কেটে যেত । তবুও একান্তে তিনি করে গেছেন সাহিত্যসাধনা । ওয়াডাসওয়ারর্থ , শেলী , রবীন্দ্রনাথ , বৈষ্ণবপদাবলী তাঁর মুখস্ত । এই মায়ের আঁচলের ছায়াতে কেটেছে  কবির শিশুবেলা । বেড়ে ওঠা । মাত্র কুড়ি বছর বয়সে কুসুমকুমারী দাশ লেখেন একটি কালজয়ী কিশোর পদ্য ‘ আদর্শ ছেলে ‘ – 

     “ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে 

         কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে । “ 

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ । বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘ নির্জনতম কবি ‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন । রবীন্দ্রনাথের সংগে তাঁর সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ হয় নি । তিনিও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন । ছয় টি কবিতা । প্রতিটির শিরোনাম – রবীন্দ্রনাথ । জীবনানন্দেরই ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তখন , “ মাথার উপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের  মত আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনিষী “ । 

তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ ঝরা পালক ( ১৯২৭ )‘ রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে ছিলেন । কবিতাগুলো পড়ে তিনি জীবনানন্দকে লিখেছিলেন – “ তোমার কবিত্ব শক্তি আছে , তাতে সন্দেহ  নেই । কিন্তু ভাষা প্রকৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কেন বুঝতে পারিনে । কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে । বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে । “ সংক্ষিপ্ত চিঠি । রবীন্দ্রনাথ  জীবনানন্দের  ওস্তাদীকে স্বীকার করেছেন । জীবনানন্দের কবিত্বশক্তি সম্পর্কে তাঁর মনে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই । এই চিঠি সম্পর্কে  জীবনানন্দ পরবর্তীকালে লিখেছেন , “ চিঠিখানি আমার মূল্যবান সম্পদের একটি । “ 

রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত জীবান্দনন্দের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন । এমন কি মূল্যায়ন করেছেন । বুদ্ধদেব বসুর ‘ কবিতা ‘ পত্রিকাতে ( সেপ্টেম্বর – অক্টোবর , ১৯৩৫ ) প্রকাশিত কবিতা হয় ।  ‘ মৃত্যুর আগে ‘ নামে একটি কবিতা । এই অনবদ্য কবিতাটি  রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । কবিগুরু সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুকে চিঠি লিখেছিলেন ,  “ জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপ আমাকে আনান্দ দিয়েছে । “ এবং কবিতার প্রথম স্তবক উল্লেখ করেছেন – 

“ আমারা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ

সন্ধ্যায় 

জনাকিতে ভরে গেছে ; যে মাঠে ফসল নাই তার

শিয়রে 

চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোন সাধ নাই তার ফসলের

তরে … “ 

রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর ১৯৩৮ সালে বাংলা কবিতার একটি সংকলন গ্রন্থ বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশ করেন  । ‘ বাংলা কাব্য পরিচয় ‘ নামে । এই সংকলনে তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘ মৃত্যুর আগে ‘ কবিতাটি স্থান পেয়েছিল । আর রবীন্দ্রনাথ-প্রসঙ্গ বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে জীবনানন্দের বিভিন্ন প্রবন্ধে নিবন্ধে । 

তথ্যসূত্র –

১।  জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ 

  ২। এত দিন কোথায় ছিলেন – আনিসুল হক ( বাংলাদেশ ) 

  ৩। আনান্দবাজার পত্রিকা –১৫ই সেপ্টেম্বর , ২০১৮ । 

  ৪ । ভোরের কাগজ , বাংলাদেশ  – জুন , ২০১৮ । 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
ঈদ এলো: ঈদ মোবারক

ঈদ এলো: ঈদ মোবারক

লুনা রাহনুমা মস্ত বড় আকাশটাতে চাঁদ উঠেছে কাস্তে সরু সোনার মতো ঝলমলে নয়, রুপার মতো মিহি পুরু। ছেলে বুড়ো বেজায় খুশি, দেখা গেছে চাঁদের হাসি ...
তিনটি কবিতা

তিনটি কবিতা

ক্ষয়িষ্ণু জীবন পেছনে সরে গেছি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে পামগাছটা একটা নিষ্প্রাণ মুখ তাকিয়ে থাকি প্রবল আর্কষণে- এভাবে ক্ষয়ে যাই পড়ন্ত বিকেল ঝরা বকুল,নক্ষত্র অথবা অশ্রæর ...
এবার মরু: শেষ পর্ব

এবার মরু: শেষ পর্ব

গৌতম সরকার সব শুরুরই শেষ থাকে, নিয়মের নিগড়ে আমাদের ট্যুরও শেষ হল। ট্যুরটা খুব উপভোগ্য হল বলতে ভালো লাগছে, কারণ আমরা বাঙালিরা যেকোনো ট্যুরকে উপভোগ্য ...
হেমন্তের দুটি কবিতা

হেমন্তের দুটি কবিতা

সন্তোষ কুমার শীল   হেমন্ত প্রভাত আমার নিকানো উঠোনে শিউলী ফুল শিশির- সিক্ত স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে এল যে লগ্ন ,বেজেছে বিদায় সুর হেমন্ত এল কুহেলীর ...
Everything You Ever Wanted to Know About Technology

Everything You Ever Wanted to Know About Technology

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান  কোরবানি দাও মনের পশু কোরবানি দাও ভালো কথা একটু দেখো ভেবে মোটা তাজা কিনবে পশু কিসের টাকা জেবে? ঘুষের টাকায় পশু কিনে ...