নেই, কোথাও কেউ

নেই, কোথাও কেউ
নেই, কোথাও কেউ

জোবায়ের রাজু

গ্রাম থেকে শহরে এসেছে দিদার। ভর্তি হয়েছে শহরের নামকরা একটি কলেজে। এই শহরে থাকার মত দিদারের কেউ নেই। তাই সে বন্ধুদের সাথে মেসে থাকে। রোজ ছয়তলা মেসের সিঁড়ি বেয়ে কষ্ট করে ওপরে উঠার সময় অনুভব করে জীবনে সাফল্যের জন্য তাকে আরো কষ্ট করতে হবে।
দিদারদের ক্লাসমেট জয়। জয়ের অন্যতম পরিচয় হচ্ছে সে দেশের খ্যাতনামা চিত্রনায়ক আকবর আলীর একমাত্র সন্তান। প্রাচুর্যের মাঝে বড় হওয়া জয়ের জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ। বন্ধুদের পাশে পথের পাশে দাঁড়িয়ে চটপটি আর ফুচকা খেতে তার আপত্তি নেই। যদিও দেশের জনপ্রিয় একজন নায়কের সন্তান হওয়াতে তার মধ্যে একধরনের অহংকার আছে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে সে। বাবার সাথে বেশ কয়েকটি টিভি শো’তে অংশও নিয়েছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এখনো সাধারণ মানুষ একজন নায়কের ছেলে বলে তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকায়। জীবনের এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জনে নিজেকে সব সময় গর্বিত ভাবে জয়। আর ক্লাসের বন্ধুরা তাদের প্রিয় নায়কের ছেলেকে ক্লাসমেট হিসেবে পেয়ে অনেকখানি ধন্য।
দিদার তার প্রিয় নায়ক হিসেবে আকবর আলীকে সবসময়ে ভেবেছে। আকবর আলীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তার ভালো জানাশোনা আছে। খবরের কাগজ, ইউটিউব, গুগল, টিভি শোতে দেখে সে তার প্রিয় নায়কের ব্যক্তিগত বিষয়গুলি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। সেই প্রিয় নায়কের ছেলে জয় তার ক্লাসমেট, এটা ভাবতে বড় আনন্দ হয় দিদারের। দিদারের মুখে জয় তার বাবা সম্পর্কে এতো আগ্রহ দেখে অবাক হল। বাবার এতবড় একজন ভক্ত আছে, এটা তার জন্য গর্বের।
২.
আকবর আলী একসময়ের সিনেমার পর্দা কাঁপানো সুপারস্টার। তবে চলচ্চিত্র থেকে তিনি বিদায় নিয়েছেন এখন। সংসার জীবনে স্ত্রী শাহানা আর একমাত্র সন্তান জয়কে নিয়ে সুখি তিনি।
ছেলে জয়ের মুখে দিদারের গল্প শুনে আকবর আলী হেসে বললেন, ‘ছেলেটাকে একদিন বাসায় নিয়ে এসো।’ জয় দিদারকে তাদের বাসায় যাবার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু দিদার ভীরু মনে আপত্তি তোলে, ‘না না, আমি পারব না এতবড় একজন নায়কের সামনে দাঁড়াতে। ভয় লাগে আমার। সুখে যে আমি মরে যাব।’ জয় দিদারের পাগলামি বোঝে। অভয় দিয়ে বলে, ‘আরে না। বাবা খুব সাধারণ। চলো একদিন।’ কিন্তু দিদারকে বোঝানো যায় না। তার নাকি এতবড় একজন সুপারস্টারের বাসায় যাবার সাহস নেই। জয়কে বলে, ‘শোনে জয়, প্রিয় মানুষদের সাথে দূরত্ব থাকাই ভালো। এতে করে তাঁর প্রতি আকর্ষণ কমবে না।’ জয় হাসে।
সত্যি জয় দিদারকে তাদের বাসায় নিতে পারেনি। এমনকী বাবার জন্মদিনে জয় যখন তার সমস্ত ক্লাসমেটদের বাসায় ইনভাইট করার পর সবাই মহাউল্লাসে আকবর আলীর জন্মদিনের পার্টিতে গেল, সেদিনও দিদারকে সবাই চেষ্টা করে নিতে পারেনি। ছেলের ক্লাসমেটদের কাছে আকবর আলী দিদারের এমন পাগলামীর গল্প শোনে হো হো করে হেসেছেন।
৩.
জয় তার বাবার সাথে সাতদিনের সফরে সিঙাপুর গেছে ট্যুরে। সাতদিন পর সিঙাপুর থেকে ফিরে এসে ক্লাসমেটদের কাছে শুনল দিদার পড়ালেখার ইতি টেনে গ্রামে ফিরে গেছে। যাবার সময় বন্ধু জাবেদের কাছে একখানা চিঠি দিয়ে গেছে জয়কে দেবার জন্য।
রাত দশটা। অবসর পেয়ে দিদার চিঠিখানা চোখের সামনে বসে ধরল। দিদার লিখেছে, ‘জয়, তোমার সাথে জীবনে আর দেখা হবে না। আর দেখা হলেও যে সত্য কখনো তোমার সামনে বলতে পারব না, আজ তা বলব তোমায়। আমার পরিচয় জেনে তুমি অবাক হবে। তোমার আমার শরীরে একই পিতার রক্ত বইছে জয়। আমার তিন বছর বয়সে মা মারা যান। বাবা আমাকে রেখে আসেন ছোটখালার কাছে। আর কখনো খবর রাখেননি। অবুঝ আমার জীবন থেকে পালিয়ে গেলেন। ছোটখালা ভেবে নিয়েছেন বাবা মারা গেছেন। হঠাৎ একদিন সিনেমার পর্দায় বাবাকে দেখা যায়। বড় হওয়ার পর জেনেছি দেশের জনপ্রিয় এক নায়ক আমার বাবা। অবলীলায় হয়ে ওঠলেন তিনি আমার প্রিয় নায়ক। খবরের কাগজে একদিন জেনেছি তিনি আবার বিয়ে করেছেন। সেই সংসারে জন্ম তোমার। ছোটখালার মৃত্যুর পর তার সৎ ছেলেরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। শহরের রাস্তা থেকে আমাকে তুলে আনেন একজন নিঃসন্তান ট্রাকচালক। নিজের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে নিয়ে আসেন। আমার এই পরিণতি তাকে ব্যথিত করেছে। আশ্রয় দিয়েছেন তার কুঁড়েঘরে। ট্রাক চালিয়ে পড়ালেখার খরচ চালাতে চালাতে এখন বড্ড ক্লান্ত তিনি। তাকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবেনা। তাই পড়ালেখার ইতি টেনে চলে গেলাম নোয়াখালীর গ্রামে। ভালো থেকো।’
জয়ের চোখ ভিজে গেল। সে জানত নায়ক হওয়ার আগে তার বাবার সংসার ছিল। সে স্ত্রী মারা গেছেন। কিন্তু সে সংসারে বাবার সন্তান আছে জানত না জয়। বাবাকে দিদারের চিঠি দেখায় সে। আকবর আলী চিঠি পড়ে আকাশ থেকে পড়েন। কাঁপা গলায় জয় বলে, ‘তুমি দিদারের ওপর অবিচার করেছো বাবা। ওর কেউ নেই।’
আকবর আলী সিদ্ধান্ত নেন কাল ভোরেই তিনি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি যাবেন। দিদারকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসবেন। ছেলের ওপর যে অবিচার করেছেন, তার জন্যে ক্ষমা চাইবেন।
বাবার সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করে জয়। কাল ভোরে বাপ বেটা নোয়াখালী গিয়ে দিদারকে বের করে নিয়ে আসবে। তারপর এই বাড়িতে ঠাঁই দেবে অভাগা দিদারকে।
ঘুম না আসা মধ্যরাতে বারান্দায় আসলেন আকবর আলী। মনটা ছটপট করছে। হারানো অতীত বাস্তব হয়ে তার জীবনে আবার এসেছে। দিদারের ওপর অন্যায় করার অনুতাপ এই মধ্যরাতে তাকে পোঁড়াচ্ছে। এরকম ঘটনা তিনি তার অভিনয় জীবনে অনেক সিনেমাতে দেখিয়েছেন, আজ সেই সিনেমার মত ঘটনা তার বাস্তব জীবনেও ঘটে গেছে। দিদারকে তার বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে এখন।
এই মাঝদুপুরে জয় ঘুমায়নি। ছেলের কাছে আসেন আকবর আলী। জয়ের কাছে দিদারের ছবি আছে কিনা জানতে চান, কিন্তু জয় দিদারের সাথে কখনো ছবি তুলেছে বলে মনে করতে পারছে না।

 

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
জাওয়ান ফুল মুভি রিভিউ [Jawan Full Movie-1080p 720p 480p

জাওয়ান ফুল মুভি রিভিউ [Jawan Full Movie-1080p 720p 480p

ছাইলিপি বিনোদন ডেস্ক আসলে শাহারুখ কে? কোন চরিত্রে দেখতে পাবেন দর্শকেরা? শাহারুখ কি হিরো নাকি শাহারুখ ভিলেন? নাকি শাহারুক হিরো এবং ভিলেনের চরিত্রে একই সাথে ...
"দ্বীনের পথে" । মো শাহাদাত হোসেন

“দ্বীনের পথে” । মো শাহাদাত হোসেন

।মো শাহাদাত হোসেন   ডাকছে মহান রব্ এসো দ্বীনের পথে, ফেলে আসো সব এসো ইসলামের ছায়াতলে।   বিশাল পৃথিবীর এই সৃষ্টির মাঝে আছে যত নেয়ামত, ...
এবার মরু: প্রথম পর্ব

এবার মরু: প্রথম পর্ব

গৌতম সরকার তখন ওমিক্রনের ভয় জাঁকিয়ে বসেছে, ব্রিটেন-ইউরোপের বেড়া টপকিয়ে ভারতেও ঢুকে পড়েছে এই ভাইরাস, মানুষকে বাইরে বেরোতে হলেও প্রতি মুহূর্তে সন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে, সেইরকম ...
বিপর্যয়ের অন্ধকারে ডুবতে বসেছে শ্রীলঙ্কা

বিপর্যয়ের অন্ধকারে ডুবতে বসেছে শ্রীলঙ্কা

ড. গৌতম সরকার   দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এক নজিরবিহীন সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছে। দেশটির অবস্থা এই মুহূর্তে এতটাই খারাপ যে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী দিনে ...
এই গ্রাম - সেই গ্রাম

এই গ্রাম – সেই গ্রাম

আশিক মাহমুদ রিয়াদ   আমার শৈশবের খুব কম সময়ে কাঁটিয়েছি আমার গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের নাম টেংরাখালী। এই গ্রামের নাম টেংরাখালী কেন- সে ব্যাপারে আমার জানাশোনা না ...
"জলমেঘের অরণ্যে " মারুফ মুহাম্মাদ এর সাথে একদিন

“জলমেঘের অরণ্যে ” মারুফ মুহাম্মাদ এর সাথে একদিন

নীল আকাশে মেঘের পরে, মেঘ যেভাবে ভাসে, মন আকাশে গল্পেরাও ঠিক এভাবে আসে.. নিঘুম রাত জমে চায়ের কাপে, প্লট, দৃশ্যপট আর চরিত্র, সংলাপে, ভূত-অদ্ভুত কত ...
Scroll to Top