শুভ্র শোভন রায় অর্ক
নীল সমুদ্রের সীমাহীন গর্জন পিছে রেখে, প্রবালের বাঁধা পেরিয়ে ডোরাকাটা লালচে বালুচর আর সবুজে মন ফিরে যায় । দ্বীপজুড়ে সারি সারি নারকেলগাছের সারি আলো-আধারি গড়ে তুলেছে মহাসমুদ্রের মাঝে। কেওড়াগাছের ঝোপঝার গড়ে তুলেছে টুকরো টুকরো বনজ পরিবেশ। শুধু সমুদ্র বিষন্নতা, একাকীত্ব, দীর্ঘশ্বাস বাড়িয়ে তোলে ; মাটি-মানুষ-সবুজ- সমুদ্র মনকে করে তোলে প্রাণচ্ছ্বোল, উজ্জীবিত। ফাগুনের টানে আমার দুচোখ এই রঙিন পৃথিবী চষে বেড়ায় ।
বালুতটে এক রুপসীর সামনের হাঁটু গেঁড়ে বসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায়। আমি দেখি, চলমান আগন্তুকদের দল স্মিতহেসে পেরিয়ে যায় ওদের।
ছেলেটার চোখে আরেক সমুদ্র যেনো উথালপাতাল। নিস্পলক চাহুনীতে ফাগুনের উড়ন্ত প্রেমের সুর।
ওর হাতে সাদা গোলাপ ; সাদা মানেই শুভ্রতা, স্বচ্ছতার প্রতীক, বন্ধুত্বের প্রতীক। এই নির্জন দ্বীপে নিশ্চয় লাল গোলাপের দেখা পায়নি বেচারা, নয়ত সাদা গোলাপ আনবে কেনো? প্রেমিকের কাছে প্রেম মানেই লাল। প্রেম তো সবসময় লাল গোলাপের মতই।
কিন্তু ওর প্রেয়সীর চোখে কেন নেই উচ্ছ্বাস ? সেখানে ভেসে উঠেছে একরাশ বিরক্তি। নিশ্চয় সে ছেলেটির বন্ধু তবে প্রেমিকা নয় কিংবা এখনো হয়ে উঠেনি প্রেয়সী !
ওদের কথপোকথন কি হয় জানতে ইচ্ছে করলো। দূর থেকে তো সব শোনা যায় না। মানুষ ভাবে ভাগ্যদেবতা সব শোনেন বোধহয়৷ তা কি করে সম্ভব যতই থাকুক দৈবীক শক্তি। আমি আরো এগিয়ে যাই ; কাছাকাছি।
এই পৃথিবীতে প্রেম ছাড়া বাঁচা বড় কঠিন৷ তারচেয়েও কঠিন সত্য প্রেমের সন্ধান পাওয়া। সত্য প্রেম স্বর্গের মতই ধ্রুম্রজালিক। কতশত কর্মের ফলে কারো জীবনে আসে কখনো-সখনো । সেই প্রেম অমৃতরসের মতই সুমধুর ; রক্তকরবীর মতই পবিত্র, সূর্যের মতই উদ্ভাসিত।
দুর্বার আমিও সেই প্রেমের সন্ধানেই ছুটে চলি বিশ্বব্রক্ষ্মন্ডের আনাচে কানাচে! অপেক্ষা করি, কখনো সুর বাঁধি, কখনো ক্লান্তিতে ডুবে যাই। কিন্তু আমিও কি যা চাই তা পাই ? আমি কি চাই?
মেয়েটি এতক্ষন সাইকেলে চড়ে বসে ছিলো। ওরা নাম নিশা। নিশার টানাটানা চোখে কাজল মাখা, ফুলের পাপড়ির মতই পাতলা ঠোঁট, মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত, ছোট্টো বোঁচা নাকের নিচে হালকা গোফের রেখা, চোয়ালের গড়ন মুখে কিছুটা কাটিন্য এনে দিয়েছে, ডোরাকাটা সাপের মত বেণী করা চুল, সে নিঃসন্দেহে সুন্দরী যদিও চেহারায় একটা ঝাঁজালো ভাব বহমান। পরনের লালচে টপসের সাথে গোটানো নীল জিন্স তার ব্যক্তিত্বের কিছুটা জানান দিচ্ছে৷
ছেলেটির কোন নড়নচড়ন না দেখে অবশেষে ও নামতে বাধ্য হলো সাইকেল থেকে। দমকা হাওয়া ওর টুপি উড়িয়ে নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। আড়চোখে তাকানো ছেলেটির মুখের সব দু:শ্চিন্তা একমুহুর্তে ধুয়েমুছে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। তা সেটা প্রেয়সীর টুপির কান্ডে নাকি সাইকেল থেকে নেমে আসায় তা জানি না ?
-কি হচ্ছে এসব ধ্রুব? দৃঢ়ভাবে প্রশ্ন করলো মেয়েটি।
-আমি…আমি তোমাকে ভালোবাসি নিশা ।
-ছোলেটি সাদা গোলাপটি এগিয়ে ধরে সামনে।
-আশ্চর্য! তোমাকে এর আগেও বলেছি আমি তোমাকে কখনো ওভাবে ভাবিনি ।
-কেনো? কারন কি? আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো।
-বুলশিট…. যাও এখান থেকে নয়ত বন্ধুত্বও আর থাকবে না। যতসব।
-প্লিজ তুমি এমন করো না। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো৷
-আমার বোঝার কিছুই নেই ৷ এসব প্রেম-টেম যত ফালতু ব্যাপার। আমাকে তুমি বাকীদের সামনে তামাশা বানিয়ে ফেলছো। দেখো সবাই হাসছে৷
কিছুটা দূরে কেয়া গাছের ঝোপের আড়ালে কিছু ছেলেমেয়ের চাহুনী জুড়ে দুষ্টামি, মুখে হাসি দেখা গেলো। নিশ্চয় ওরা এদেরই বন্ধুদেরদল। সবাই এদের কান্ডকারখানা দেখে মজা পাচ্ছে।
-হাসুক। তোমার জীবনে তো অন্য কেউ নেই তবে ?
-তাতে কি?
-আমাকে একটু সুযোগ দাও।
-ইচ্ছে নেই।
নিশা ছটকায় সাইকেলে উঠে রওনা দেয়। পিছনে ধ্রুব হাঁটুগেড়ে তেমনি বসে থাকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়, ওর মাথায় যেনো সুবিশাল আকাশ নেমে আসতে চায় । এক নিকষ অস্হিরতা ঘিরে ধরতে চায়।
আমি ভাবছিলাম আহারে হতভাগ্য ছেলেটা। বোধহয় আরো একটি গল্পের সমাপ্তি হলো, আরো একটি ব্যর্থ প্রেমের সংবাদ ডালপালা মেলবে৷ হাসবে বন্ধুদের দল। কিন্তু প্রকৃতির কাছে আমি যেমন অভিনবত্ব খুঁজি তেমনি পেলাম হঠাৎ৷
ধ্রুব উঁঠে দাঁড়ালো, গোলাপের ডাঁটি ঠোঁটে চেপে গাছে ঠেস দেয়া নিজের সাইকেলটি নিয়ে রওনা হলো নিশার পিছনে৷ আমার মনও চনমনে করে উঠলো। ” সাব্বাস ” এই তো চাই । প্রেমিকরা এত জলদি হার মেনে নেয় না। প্রেয়সীর মন সর্বদাই দুর্বার দেয়াল, তা অতিক্রম কখনোই সহজসাধ্য নয় তারমানে অনতিক্রমও নয়। ভালোবাসা ভেঙে দিতে পারে সব দুর্ভেদ্য দেয়াল। লেগে থাকো ধ্রুব। অভিমানের খেলা শেষ হবেই।
মাঘের শেষে ফাগুন নিয়ে আসে হলুদ, সাদা, লাল, নীল, সবুজের নতুন বাহার। চারদিকে নতুনের আঁকিবুঁকি, চারদিকে রংধনুর মত প্রেমের মৌসুম জাগে৷ ভ্রমরদল দলবেঁধে এগিয়ে চলে ফুলে ফুলে, খেঁজুরের ডালে ডালে দোয়েলের হাঁকডাক, গাছে গাছে নতুন পাতা, কুয়াশা ভেজা সকাল পেরিয়ে দীগন্তজুড়ে উৎসব, ঘরেবাইরে শান্তির বার্তা ৷ প্রকৃতি প্রতিবারই নতুন করে ভালোবাসার সৌরভ ছড়িয়ে দিতে থাকে। বয়সন্ধি পেরোনো বালকটি সহপাঠীর মাঝে মনের টান অনুভব করে, ওকে দোলা দিয়ে যায় নতুন কোন স্বত্বা -ছোঁয়া যা আগে কখনো ছিলোনা। প্রেম ঝড়ে পড়ে বালিকার পাঠ্য বইয়ের ভাঁজে, সে বাধ্য হয় চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার তবুও মনে পড়ে যায় দুবাড়ি পিছনের ছেলেটার কথা৷ প্রেম সে ছাড় দেয়না লুকোনো অব্যক্ত ভালবাসাকেও, ছুটে চলে, বাসাবাঁধে ঘরে-বাইরে, সিক্ত করে হাতে রাখা প্রতি হাতে । মাখামাখি করে এগিয়ে যায় ঝোঁপঝাঁপ ভেঙে প্রতিটি অলিগলিতে। তরুনী-যুবতীরা খোঁপায় ফুল গুজে রঙিন শাড়িতে বাঙালীআনার সুরভী ছড়িয়ে তোলে জীবনে। ঝরনার মত প্রবাহিত হতে থাকে বার্ধক্য থেকে যৌবন, কৈশর থেকে তারুন্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সমুদ্রের ভেজা বালিতে জোড়ায় জোড়ায় তারন্যের পাখিদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । ওদের পায়ের ছাপ মুছে নিতে পারেনা ওই সমুদ্রের নোনা স্রোতও। নিজেদের নতুন করে আবিস্কার করে চলে । প্রকৃতির নতুন পরিবেশে বাঁধনছাড়া হয়ে যায় হাতে হাত রেখে৷ ভালোবাসা ছাড়া জীবন চলতে পারে না। ভাঙা-গড়া ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না যেমন তেমনি নিজেকে বাঁচাতে লাগে প্রিয় সঙ্গী।
আমি পিছু নেই ধ্রুবর। কাঁচা বালুতে চাকার রেখে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথ ধরে ধরে এগিয়ে যাওয়া যতক্ষন না মেয়েটার হদিশ পাওয়া যায়। সর্বশক্তিতে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরাতে থাকে ও।
নারকেল বাগানের সারি সামনের রাস্তাকে বড় বাঁকে ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। ধ্রুব বাঁক পেরুতেই দ্বীপের এমন অংশ এসে যায় যেখানে মানুষের আনাগোনা কম। পরিত্যক্ত বাড়ির ভগ্নাংশ চোখে পড়ে। সোজা রাস্তা এখানে শেষ, পার্শ্বরাস্তা চলে গিয়েছে বামে। ধ্রুবর চোখ নিশার খোঁজে দিকবেদিক হয়। প্রেমিক তো এমনি হয় ; মুহুর্তের চোখের আড়াল যেনো হাজার বছরের দূরত্বের সমান, শুধু হারানোর ভয় শঙ্কা দেখায়।
ঠিকই নিশাকে খুঁজে নেয় ধ্রুবর চোখ। সে তখন এলোমেলো ভাবে প্রবাল পাথরের উপর বসা পায়ে হাত দিয়ে । সাইকেলটা পড়ে আছে একদিকে। ধ্রুব সাইকেল থেকে নেমে ওর দিকে এগিয়ে যায়। নিশা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে পায়ে। ও পা ধরে দেখতে চায় কিন্তু নিশা ওকে সরিয়ে দেয়৷ ধ্রুব ওর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তুমি কি হাঁটতে পারবে?
নিশা মাথা নাড়ায়। হয়ত পা মচকে গিয়েছে!
ধ্রুবও ওর পাশে প্রবালে বসে পড়ে। দুটো মানুষ বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই থাকে ।জনমানুষহীন সমুদ্রের বিশালতা ওদের আবারো মুগ্ধ করে। বড় বড় ঢেউগুলো ফেনা তুলে আচড়ে পড়ে কিনারে আবার ফিরে চলে আপন তালে। সময় এখানে থমকে যায়। এক একটা মুহুর্ত দীর্ঘ হয়ে ওঠে। নিশার কুঁচকানো ভ্রুজোড়াও একসময় স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ওর চোখের কোণা কোন অপ্রাপ্তিতে চিকচিক করে ওঠে। ও যার সাথে চেয়েছিলো এ সমুদ্রমন্থন সে কখনো ওর ছিলো না। ও ধ্রুবর দিকে এক ঝলক দেখে । রোদেপোড়া সুদর্শন ছেলেটির চুলগুলো এলোমেলো উড়ে চলেছে। অভিমানের ছাপ মিশে গেছে ওর আরষ্ঠতায়। নিশা তো ওকে চেনে। বহুদিনের বন্ধু ওরা৷ ধ্রুবকে কেনো ও কষ্ট দিচ্ছে? যে কষ্ট ও নিজে পেয়েছে ধ্রুবকেও কি তা দিচ্ছে না? ও নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি কি সারাজীবনই একা থাকতে পারবো? পারবো না তো? কেউ না কেউ তো আসবেই জীবনে। তাহলে কেনো….
ধ্রুব হঠাৎ উঠে পড়ে। নিশার সামনে সমুদ্রকে আড়াল করে দাঁড়ায়। কোন কথা না বলে নিশাকে পাঁজকোলা করে তোলে। নিশা বাঁধা দিতে গিয়েও দিতে পারে না। অস্বস্তিতে ভোগে, ওর টুপিটা মাথা থেকে খুলে পড়ে। ধ্রুব নিশার চোখে যদি তাকাতো তবে দেখতো কিভাবে ওর অভিমানী দুচোখ পৃথিবীকে ছাড়খাড় করে তুলেছে। নতুন সুরের ঢল সেখানে।
ধ্রুব ওকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে দেয়। তারপর ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। নিশা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে।
ওরা চলতে থাকে কংক্রিটের রাস্তা ধরে সুবিশাল সুপারি আর নারকোলের বাগান চিড়ে । ইস, যদি এখানে থাকতো ডানামেলা কৃষ্ণচূড়া আর সুবিশাল শিমুলের সারি। আমার ইচ্ছে করে আকাশে রংধনু ফুটিয়ে কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের লালরঙে ওদের রাঙিয়ে দিতে ৷ তবুও থেমে যাই আরো ঘটনার পরিক্রমার জন্য ৷ অপেক্ষা করতে থাকি আরো দ্বিগুন মাধবীমায়ার….৷
লালমনিরহাট, বাংলাদেশ