বিপর্যয়ের অন্ধকারে ডুবতে বসেছে শ্রীলঙ্কা

বিপর্যয়ের অন্ধকারে ডুবতে বসেছে শ্রীলঙ্কা

ড. গৌতম সরকার

 

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এক নজিরবিহীন সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছে। দেশটির অবস্থা এই মুহূর্তে এতটাই খারাপ যে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী দিনে না সমূহ রাষ্ট্রের পতন ঘটে। সরকারের পতন ঘটলে বিকল্প সরকারের কাছে একটা সুযোগ থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর, কিন্তু রাষ্ট্রের পতন ঘটলে দেশটি সমূলে বিনষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অশনি সংকটের এই মায়াজালে হাঁসফাঁস অবস্থা দেশটির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারতন্ত্র, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা দেশটিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। অথচ শতভাগ শিক্ষিত দেশটির সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। প্রাকৃতিক সম্পদে সাজানো এই অপরূপ শহরে দেশবিদেশ থেকে সারাবছর পর্যটক সমাগম লেগেই থাকত। আপাত স্থিতিশীল দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল পর্যটন থেকে প্রাপ্ত আয়, আর বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স। দুবছর আগেও কিছু বোঝা যায়নি, মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন, ধর্মীয় বৈচিত্র্য, নাইট লাইফ, উপকূল ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু দিব্যি চলছিল, তারপর অকস্মাৎ সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতা অবশিষ্ট বিশ্বকে অবাক করেছে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে যতই বলুন না কেন তাঁর দেশ শুধুই অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে, গোটা বিশ্ব জেনে ফেলেছে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংকটও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর কখনও এতটা দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়নি। শ্রীলঙ্কা মূলত একটি আমদানিনির্ভর দেশ। এই মুহূর্তে বিদেশী মুদ্রার তীব্র সংকটে অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ যেমন, পেট্রোল, ডিজেল, খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে পারছে না। যার ফলে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিপুল খাদ্যাভাব। মানুষ এক প্যাকেট দুধ, এক টুকরো পাউরুটির জন্য এক দোকান থেকে অন্য দোকানে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে, যোগানের অকুলানের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি।
হাতে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই, সারাদিনে ১২-১৪ ঘন্টা লোডশেডিং, এই ত্র্যহ স্পর্শে নাজেহাল সমগ্র দেশবাসী। এমনকি কাগজকলম আমদানি করার মতোও পয়সাও সরকারের হাতে নেই, যার ফলে বাতিল হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষা। দেশের এক প্রাক্তন ডিপ্লোম্যাটের কাছে দেশটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাওয়ায় উত্তর পাওয়া গেল, “নো ডলার, নো ডিজেল, নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো ফুড।” সাধারণ মানুষ ধৈর্য হারিয়ে রাস্তায় নেমে স্লোগান তুলেছে, ‘গো ব্যাক গোতাবায়ে, লেট ফ্যামিলি রুল বি অ্যাবোলিশড।’ তারা প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ভাঙচুর করেছে, সেনা জওয়ানদের বাসে ঢিল ছুঁড়ছে, সরকারি বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে, যার ফলশ্রুতিতে এপ্রিল মাসে দেশ জুড়ে একদফা জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। মাঝে কিছুদিন বিধিনিষেধ একটু শিথিল হলেও পরিস্থিতি আবার হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় কয়েকদিন আগে আবার নতুন করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার সমস্ত ধর্মের মানুষ, সিংহলি, তামিল, মুসলিম, বুদ্ধিস্ট সবাই গোতাবায়ের পরিবারতন্ত্রের অবসান চায়। অস্ট্রেলিয়াবাসী শ্রীলঙ্কান গবেষক ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মি. শচিন্তা আবেসুরিয়ার মতে, ‘এই মুহূর্তে কিছু অযোগ্য এবং অশিক্ষিত মানুষ দেশটি শাসন করছে। সরকার বা পার্লামেন্টে এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই যিনি নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারবেন কোন প্রজেক্টটি গ্রহণযোগ্য এবং কোন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ বিনিয়োগ সঙ্গত আর কোনগুলিতে নয়।’ তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা হল, সরকারকে বুঝতে হবে কোন প্রজেক্ট গ্রহণের মধ্যে দিয়ে দেশের জিডিপি বাড়বে, অর্থনীতিতে অর্থের যোগান বাড়বে, সেই ধরণের প্রজেক্টের জন্য যদি ঋণ নিতে হয় তাহলে সরকার নির্দ্ধিধায় নিতে পারে, কারণ আগামী দিনে এই প্রজেক্টগুলি যে রেভিনিউ দেবে তার থেকে ঋণ পরিশোধ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুটোই হওয়া সম্ভব।
শ্রীলঙ্কার সংকট বহির্বিশ্বের নজরে প্রথমবারের জন্য এল যখন দেশটি বাংলাদেশের কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করলো। যদিও তার বেশ আগে থেকেই তাদের অর্থনীতিতে ভাঙন ধরতে শুরু করেছে। বিদেশি মুদ্রার তহবিল দ্রুত গতিতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া থেকে সমস্যা শুরু। ২০১৯ সালে গোতাবায়ে রাজাপক্ষে যখন প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন তখন বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে জুলাই মাসে সেটা কমে হয় ২.৮ বিলিয়ন, এবং গত নভেম্বরে আরও কমে ১.৫৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এই মুহূর্তে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে পড়ে আছে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার।

 

এই লেখা দ্বারা নির্মিত  ডকুমেন্টরি দেখুন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেলে-

 

 

চিনের সঙ্গে সম্পর্ক, কোভিড পরিস্থিতি ঠিক করে সামলাতে না পারা, অলাভজনক প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের টাকা বিনিয়োগ, সীমাহীন দুর্নীতি, অযোগ্য প্রশাসন ব্যবস্থা সবকিছু মিলেমিশে আজ দেশটা দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছে। সচিন্তা আবেসুরিয়া এবং পশ্চিমা ডিপ্লোম্যাটদের বক্তব্য হল, শ্রীলঙ্কার রপ্তানিবাবদ মোট আয় হল ১০ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি বাবদ খরচ ২০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ লেনদেন ব্যালান্সে বাৎসরিক ঘাটতি ১০ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি পূরণ হয় পর্যটন থেকে আসা ৩ বিলিয়ন এবং বিদেশ রেমিট্যান্স বাবদ আসা ৬-৭ বিলিয়ন ডলার দিয়ে। কিন্তু সব হিসেব উলটপালট করে দিয়েছে গত দুই-আড়াই বছর ধরে চলতে থাকা কোভিড মহামারি। পরিসংখ্যান বলছে, স্বাভাবিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় বছরে গড়ে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন পর্যটক আসে, সেখানে ২০২০ সালে পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ ছিল আর গতবছর লকডাউন একটু শিথিল হওয়ার পর পর্যটক এসেছিল ছিল মাত্র আশি হাজার। অন্যদিকে অতিমারির কারণে ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেসমস্ত শ্রীলঙ্কান কাজ করত সবাই দেশে ফিরে এসেছিল, পরে সরকার তাদের অন্য কোথাও পাঠাতে পারেনি বা দেশেও বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এবিষয়ে সরকারি তরফে তেমন কোনও চেষ্টাও চোখে পড়েনি। সেকারণে একদিকে পর্যটন খাতে আয়ের সংকোচ এবং অন্যদিকে রেমিট্যান্স বাবদ আয় হ্রাস বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি দিনদিন বাড়িয়ে তুলেছে। এর মধ্যে আবার ঋণের কিস্তি মেটানোর সময় উপস্থিত হয়ে গেছে। শর্ত অনুযায়ী কয়েকবছর পর থেকে ঋণের কিস্তি মেটানো শুরু হয়, সেই কিস্তি মেটাতে গিয়ে আজ দেশটি সর্বসান্ত হতে বসেছে।

বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ দেশটির সমূহ বিপর্যয়ের নানান কারণ খুঁজে বের করেছেন।

এক, অলাভজনক এবং অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগ:
ব্যক্তিমালিকানাধীন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লার্ন এশিয়া’-র সভাপতি রোহন সমরজিভার মতে, ২০০৭ সাল থেকে দেশটি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে অলাভজনক ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করে গেছে। গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কান সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প শুরু করেছে, যেমন- হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর, মাট্টালা বিমানবন্দর, লোটাস টাওয়ার, স্টেডিয়াম ইত্যাদি৷ এইসব প্রকল্পে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করা হচ্ছে যেগুলো কোনোভাবেই দেশীয় অর্থনীতিতে অর্থের যোগান বৃদ্ধিতে কোনওরকম সাহায্য করবে না। হংকং, সিঙ্গাপুর, এবং দুবাইকে টেক্কা দেবার জন্য রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্র থেকে জমি বের করে ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’ নামের এক বন্দর শহর গড়ে তোলা হচ্ছে, যেটার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সময়কাল ২৫ বছর। এই বিশাল দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই চিনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে, আগামী দিনে দেশের আর্থিক বনিয়াদ মজবুত করতে এই প্রকল্পের যোগদান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও মতবিরোধ আছে৷ কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বরিষ্ঠ অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নের মতে, গৃহিত বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প ইতিমধ্যেই দেশটির জন্য হাতিপোষার সামিল হয়ে গেছে। ড. আবিরত্নের মতে, গত দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কায় বিদেশি বিনিয়োগ তেমন হয়নি বললেই চলে। দেশের সরকার বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনও চেষ্টা না করে দিনদিন বিদেশি ঋণের নব নব উৎস সন্ধানে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। গত এক দশকে শুধু চিনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণই পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ জুগিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, এবং জাপান। বিশ্লেষকদের মতে এই ঋণের বেশিরভাগটাই অপ্রয়োজনীয় এবং অলাভজনক প্রকল্পে ব্যয় করায় দেশটিতে মূলধনের স্বাভাবিক আবর্তন প্রবাহ থমকে গেছে। আজকের এই চরম দুরাবস্থা অনেকটাই অযৌক্তিক ও অনুপযুক্ত নীতির ফল বলে মনে করেন অধ্যাপক শ্রিমাল।

 

দুই, ২০১৯ আর্থিক বছরে ট্যাক্স ছাড়:
গোতাবায়া রাজপক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। প্রথমেই তিনি সেই আর্থিক বছরের জন্য ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। ভ্যাটের পরিমান ১৫ শতাংশ থেকে কমে ৮ শতাংশ হয়, এছাড়া আয়করেরও উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটে। কর কমানোর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল মন্দাক্রান্তা অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় গতি সঞ্চয় করা। একই নীতি ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে গ্রহণ করেছিলেন এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালের কর সংক্রান্ত নরম নীতি শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ব্যুমেরাং হয়ে দেখা দিল, বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারীকেই এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে৷
অর্থনীতিবিদদের হিসেব অনুযায়ী, আয়কর ও ভ্যাটের যুগ্ম হ্রাসে সরকারের রাজস্ব আদায় প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়। তার উপর করোনা সংক্রমণের কারণে দেশটির আভ্যন্তরীণ এবং বহির্বাণিজ্য সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এর মধ্যেই আগের নেওয়া ঋণগুলোও
শর্ত মেনে শোধ করার সময় হয়ে গেছে। এই কর ও করোনার যুগ্ম ফলায় ২০২২-এ দ্বীপরাষ্ট্রটি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে।

তিন, পর্যটন খাতে বিপর্যয়:
বৈশ্বিক সূচক সংস্থা মুডির ইনভেস্টর সার্ভিস জানিয়েছে, পর্যটন খাতের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দেরি হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার বিপর্যয় এতটা তীব্র রূপ ধারণ করেছে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার বড় যোগান আসে পর্যটন ক্ষেত্র থেকে। গত দুই বছর অতিমারীর কারণে এই খাত সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে গেছে। অতিমারীর আগে শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসতো চিন থেকে। করোনা ভাইরাসের আঁতুরঘর চিন তাদের দেশে পর্যটন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ যথেষ্ট কড়াকড়ি করায় পর্যটক সমাগম প্রায় শূন্যে নেমে আসে৷ পর্যটন খাতে বিপর্যয় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমনের আগে পর্যটন এবং রেমিটেন্স খাতে দেশটির বার্ষিক আয় হত ১০ বিলিয়ন ডলার। আজ সারা দেশ জুড়ে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের হাহাকার মানুষের জীবনযাত্রায় চরম অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে চার্চগুলোতে সিরিজ হামলার ঘটনাও দেশটির পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ।

চার, বিদেশি ঋণের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা:
শ্রীলঙ্কার এই সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। বিগত ১৫ বছরে এই সমস্যা একটু একটু করে ঘনীভূত হয়েছে। যে সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন বা দেশীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের দিকে না গিয়ে চটজলদি বিদেশি ঋণের সাহায্যে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে জনগণকে চমকে দিতে চেয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে ২০০৭ সাল থেকে শ্রীলঙ্কান সরকার অর্থ সংগ্রহের জন্য সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করতে শুরু করেছিল।
অর্থনীতির মতে, একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেলে অতিরিক্ত ব্যয় বহনের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে কোনও দেশ এই সার্বর্ভৌম বন্ড বিক্রি করে অর্থের সংস্থান ঘটাতে পারে। শ্রীলঙ্কা সেভাবেই তাদের বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থ যোগাড় করেছে। কিন্তু সেই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করবে সেই উপায় খোঁজার জন্য অর্থনীতিবিদদের মতামত নেয়নি। এই মুহূর্তে সার্বভৌম বন্ড বাবদ দেশটির ঋণের বোঝা সাড়ে বারো মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কাকে চুক্তিমতো সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। এই আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে বিশাল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা দেশটির নেই, বলাই বাহুল্য। যদিও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছে। তারা জানিয়েছে, গত দুইবছরে সার্বভৌম বন্ড বাবদ যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়ে গেছে এবং জানুয়ারি মাসে সর্বশেষ ৫০০ মিলিয়ন ডলার শোধ করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেটি বলছে না সেটি হল, এই ঋণ শোধের কারণেই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছেছে, আর তার ফলশ্রুতিতেই দেশ জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে জ্বালানি তেলে আকাল দেখা দিয়েছে।

পাঁচ, অনুপযোগী অর্থনৈতিক নীতি:
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর ভি এ ভিজেওয়াদানা বলেছেন, ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু মৌলিক ভুল করেছে। তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে জিডিপির ৩০ শতাংশ আসতো রপ্তানি থেকে। সেটা এখন ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। এমত পরিস্থিতিতে দেশের সরকার শ্রীলঙ্কান রুপির অবমূল্যায়ন ঘটায়নি। যার ফলে নিট রপ্তানিতে কোনও ইতিবাচক প্রভাব না পড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার, কমতে কমতে এখন সেটা দুই বিলিয়নেরও নিচে নেমে এসেছে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য মুদ্রার পরিমান মাত্র তিনশ মিলিয়ন ডলার। জ্বালানি তেল কেনার মত অর্থও সরকারের নেই, চরম বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে বিঘ্নিত হচ্ছে বাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।

ছয়, অর্গানিক চাষে বিপর্যয়:
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে দেশ জুড়ে অর্গানিক কৃষিকাজ চালু করেন। পরিবেশগত কারণে এবং দূষণ প্রতিরোধে এটি অতীব তারিফযোগ্য সিদ্ধান্ত৷ তবে এই অর্গানিক চাষে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কৃষির উৎপাদনশীলতায়৷ চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে গেছে৷ একদা খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটিকে বাধ্য হয়ে বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার চাল আমদানি করতে হয়। দেশের বাজারে চালের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। শুধু চাল নয়, অর্গানিক চাষের প্রভাব চা-শিল্পতেও পড়েছিল। চা রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা বেশ ভালো পরিমাণ বিদেশিমুদ্রা অর্জন করে, উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেখানেও একটা জোরদার ধাক্কা এসে লেগেছে। অন্যদিকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ফলত দেশ জুড়ে খাদ্য ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। অধ্যাপক আবিরত্নে বলেছেন, অর্গানিক চাষ শুরু করার আগে সরকার পদ্ধতির ভালো-মন্দ নিয়ে কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করেনি। যার ফলে দেশবাসীদের উল্টো ফল ভোগ করতে হচ্ছে৷ বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে এবং খাদ্যের অভাব মেটাতে খাদ্যশস্য আমদানি করতে গিয়ে বিদেশিমুদ্রার তহবিলে আরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার সংবিধান বলছে, কোনও কারণে রাষ্ট্রপতি অপসৃত হন বা পদত্যাগ করেন তাহলে প্রধানমন্ত্রী সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সে পথও বন্ধ, কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তাই সংবিধান অনুসরণ করলে সাধারণ মানুষের পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদের ব্যাপারটাই ধাক্কা খাবে। দেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ এবং থিংকট্যাঙ্ক শচিন্তা জয়সুরিয়ার মতে, ‘মানুষের দাবি একদম সঠিক। সমগ্র দেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করছে এই পরিবারতন্ত্র। পারিবারিক রাজনৈতিক জমিদারি কায়েম করার জন্য পরিবারের ও দলের অযোগ্য সুবিধাবাদীদের নেতা বানিয়েছে এবং ক্যাবিনেটের মন্ত্রী পদে বসিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো চাইছে দলমত নির্বিশেষে একটা জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। শচিন্তা মনে করছেন, ‘এটা কোনও বিকল্প পথ নয়। তারা বর্তমান সরকারের পতন চাইছে ঠিকই কিন্তু দেশকে এই মহা সংকট থেকে বের করে আনার কোনও বিকল্প পথের সন্ধান জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। সুতরাং জনগণের চোখে বিরোধীরা গোতাবায়া সরকারেরই আরেকটা রূপ।’
শ্রীলঙ্কার এই চরম বিপদে ভারত সরকার সর্বতোভাবে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। মোদি সরকারের অনুরোধে ‘ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন’ ৬০০০ মেট্রিক টন তেল ‘সিলন ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড’-কে পাঠিয়েছে। এছাড়া ভারত এক লপতে ৪০,০০০ টন চাল পাঠিয়েছে এবং আগামী দিনে আরও পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর সাথে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শরণার্থীর দিনদিন বেড়ে চলেছে, তারা আসছে স্রেফ পেটের তাগিদে, ভারত সরকার এব্যাপারেও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
এটা খুব স্পষ্ট যে এই সমস্যার কোনও আশু সমাধান নেই। প্রধানমন্ত্রী ইস্তফা দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট সহিংসতা রুখতে দেশ জুড়ে আবার জরুরি অবস্থা জারি করেছেন, কিন্তু এগুলো তো কোনও সমাধান নয়। রাজনীতির রং নির্বিশেষে শুভ চিন্তকদের সম্মিলিত প্রয়াস আর বিশ্বের আপামর দেশের সহযোগিতাই আগামী দিনে দেশটিকে স্থিতাবস্থায় ফিরতে সাহায্য করবে। দেশের প্রতিটি মানুষ এখন কোনও এক জাদুদণ্ডের স্বপ্নে দিন কাটাচ্ছে, কোনও এক মনোরম সকালে ঘুম ভেঙে তারা উপলব্ধি করবে, আরে এটা তো একটা স্বপ্ন ছিল!

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
বৃষ্টি একটি নদীর/নারীর নাম

বৃষ্টি একটি নদীর/নারীর নাম

ড. গৌতম সরকার “আচ্ছা, বৃষ্টির শব্দের মধ্যে তুমি সুর খুঁজে পাও?” “সুর? কিসের সুর?” “কেন গানের…তানের, একেকটা বৃষ্টি একেক রকমের রাগ-রাগিনী হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে ...
ক্রান্তিকাল

ক্রান্তিকাল

কাজী আশিক ইমরান দেখেনি কেউ অপরাহ্ন,আহ! কতোদিন থেমে ছিল মৃদু পরিমল। শান বাঁধানো খোলা ডাস্টবিন আবর্জনা নয়, লাশের স্তুপ চেয়েছিলো। ক্রিং ক্রিং হর্নে জেগে উঠা ...
গর্ভধারিনীর চোখে

গর্ভধারিনীর চোখে

জয়ন্ত দাস ওই ঘাতক হায়েনার দল আমাকে বাঁচতে দিল না, ওরা আমার নব অরূণোদয়,সদ্যজাত অঙ্কুরিত বীজকে সেই বর্বরোচিত কালরাতের মতো পিশাচের ন্যায় গলাটিপে হত্যা করেছে। ...
অনুরাগ

অনুরাগ

আশিক মাহমুদ রিয়াদ আমার ভালবাসা, আমি যখন তোমার চোখের দিকে তাকাই, আমি অনুভব করি যে আগুনের গভীরে জ্বলছে। তোমার স্পর্শ আমার মধ্যে একটি শিখা জ্বালায়, ...
অন্তঃবৃত্ত (রোমান্টিক গল্প)

অন্তঃবৃত্ত (রোমান্টিক গল্প)

আশিক মাহমুদ রিয়াদ শুকনো পাতার খসে যাওয়া দিন! আকাশে মেঘের গুরুগম্ভীরভাব। পথের ধার ঘেসে হাটা মানুষের বেশিরভাগের মাথাতেই এলোপাথারি চিন্তাভাবনা ঘোরে। রাশেদ ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ...
সম্ভোগ

সম্ভোগ

আশিক মাহমুদ রিয়াদ একটি বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা, নভেম্বরের বৃষ্টি ঝড়ছে আকাশ থেকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত শীত ঠেসে পড়া বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ লোকজন মারা গিয়েছে।মফস্বল শহরের ...