সন্ধ্যা নেমে এসেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। পূর্ণিমার তারাগুলো যেন ঝলমল করছে মর্মর সৌধের বুকে। প্রধান ফটকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। সামনে গোলাপ,ড্যাফোডিল,আশ্চর্য রকম সুন্দর ফুলরাজিতে সুসজ্জিত চাহার বাগ উদ্যানের ভিতরকার যমুনা নদী নিসৃত ঝর্ণার জলধারায় সৃষ্ট রাতের আলোমাখা পুষ্করিণীর পাশ দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে।
আমার পিছনে গুলাম মহম্মদ নামে এক বৃদ্ধ গাইড। এখানে ঢোকার কিছু আগেই সে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আদ্যন্ত সাদা উলের চাদরে ঢাকা চাপ দাড়িওয়ালা ছয় ফুট লম্বা হিলহিলে চেহারার মানুষটা তরতর করে হেঁটে গেল শ্বেত পাথরের সোপান বেয়ে মিনারের কাছে।
মাথার ওপরে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। এক অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ চারিদিকে। শীতের হিমেল হাওয়া। মার্বেলের শিলায় পা রাখা মাত্র জ্যোৎস্না রাতের রোমাঞ্চ যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে গ্রাস করলো আমার মনকে। কিন্তু আজ এমন এক মূহুর্তে জায়গাটা এরকম জনপ্রাণীহীণ কেন? নিজের মনকেই বললাম,’ লোকজনের মাঝে বোধহয় এই সৌন্দর্যকে এত অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করা যেত না। এই মার্বেল শিলায় পা দিয়ে একাকি নিজেকে কেন যে এত ভাগ্যবাণ মনে হচ্ছে বারবার…এই অপার্থিবতার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্যই যেন জন্মজন্মান্তর ধরে অপেক্ষা করে ছিলাম আমি…যার টানে পুজোর ছুটি কাটাতে একা একাই ছুটে এসেছি কলকাতা থেকে সুদূর এই আগ্রায়।
বাদামী মার্বেলের সোপান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুহকিনী সৌধের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই যেন অজান্তে বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, ‘লাভ পোয়েম ইন এ মার্বেল…। ‘
মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গুলাম মহম্মদ একটু হেসে বিশুদ্ধ হিন্দিতে আমায় বললো,’ আসুন জাঁহাপনা। দেখে নিন চারিদিক। প্রেম আর হাহাকার কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে পাথরের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে…কোণায় কোণায়। এমন মুহূর্ত আর পাবেন না জীবনে, এই নীরবতা, নির্জনতার মধ্যে দিয়েই তো তারা আসে। রোজ রাতে আসে। কারা যেন কথা বলে ফিসফিস করে…এসব কাহিনী বংশপরম্পরায় শুনে আসছি…আগ্রা শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়….এসেই যখন পড়েছেন একবার তার আস্বাদ নেবেন না? ‘
আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গুলাম।
বলতে পারতাম,’ সেই অদৃশ্য লোকের মানুষ গুলোর সঙ্গে তুমি বুঝি মোলাকাত করেছো? ‘
যুক্তি তর্কে গেলাম না। যাওয়ার মতো মানসিকতাও তখন আমার নেই। কারণ সেই মুহূর্তে আমার অন্তঃকরণ জুড়ে শুধুই বিচরণ করছে তাজ। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর মন প্রাণ ঢেলে উপভোগ করছি চাঁদনি রাতে মার্বেল গাত্রে আঁকা চিরন্তন প্রেমের স্বর্গীয় রূপকে।
আমার সহযোগী বলে চলে,’সম্রাট প্রিয়তমাকে ধরে রাখতে পারেন নি বেশিদিন,চতুর্দশ সন্তানের জননী হতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দেয় সে অপ্সরা রাজেন্দ্রাণী… বিরাট বিরহী বুকে আঁকড়ে থাকা সেই স্মৃতি আজও অমর; চিরন্তন কালের জন্য। যে স্মৃতি কথা বলে ওঠে কালের স্রোত বেয়ে…কিন্তু এর বাইরে আর কি কেউ কথা বলে ওঠে না? তাজমহল তো সেই হাহাকারেরই আরোএক রূপ..! নৈঃশব্দের আড়ালে কিছু শুনতে পাচ্ছেন জাঁহাপনা? ‘
অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো গুলাম মহম্মদ। আমার থেকে হাতকয়েক দূরে উদ্যানমুখী মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোটরগত চোখদুটো তাকিয়ে আছে আমার উত্তরের অপেক্ষায়। মণিগুলো আশ্চর্য রকম নীল। নীচের চারবাগ উদ্যানের সুরম্য পুষ্করীণীর জলে প্রতিবিম্বিত তাজমহলের ভেসে চলা আবছায়া রূপের মতোই রহস্যময় সে দৃষ্টি।
আস্তে আস্তে এবার আমার কাছে এগিয়ে আসে গুলাম। ফিস ফিস করে বলে,’ আমি যা বলবো তা শুধু অনুভব করুন। ঠিক শুনতে পাবেন। সমাধিস্থলের মূল প্রবেশ পথের দিকে তাকান একবার। গম্বুজের দেওয়াল গাত্রে আঁকা জারি, ছেদ যুক্ত সূক্ষ্ণ সূচীকর্মের অদ্ভুত নির্মাণ শৈলী, খোদিত কোরাণের বাণী…এই আশ্চর্য নকশার কাজ যার মস্তিষ্ক প্রসূত…ফটকের গায়ে ঐ দেখুন ফার্সিতে খোদাই করা সে নাম…জ্বলজ্বল করছে আজও…পারস্যের নামজাদা চারুলিপিকার আমানত খাঁ….ঐ যে ঐ দেখুন, ছত্রে ছত্রে জ্বলজ্বল করছে মূল স্থপতিকার আহমেদ লাহোরি নামটুকু…জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ বাইশ বছর ধরে হুমায়ুনের মাজার, ইমাদউদ্দৌল্লার মাজার, তিমুরের গুর ই আমির, দিল্লির জামি মসজিদের গঠন শৈলীকে সামনে রেখে, ইন্দো-ইরাণীয় তুরস্কের স্থাপত্য রীতির আশ্চর্য সংমিশ্রণেএকটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন যে স্বপ্নের তাজ…সে সব রক্তের দাগ অনাদিকাল ধরে চাপা পড়ে আছে এই পাথর স্তূপের নীচেই….জাঁহাপনা আসুন….
পাথরের গায়ে এই যে দেখছেন ভুবন ভোলানো খাঁজকাটা শিল্পকর্ম… মোজাইক শিল্পের এমন অদ্ভুত নমুনা দিল্লির প্রখ্যাত পাথর খোদাই কারক চিরঞ্জিলাল ছাড়া আর কে ই বা পারতো সৃষ্টি করতে। …ঐ অত্যাশ্চর্য মোচাকৃতি গম্বুজ,স্বর্ণখোচিত চূড়া…যা সৃষ্টি করবার জন্য সুদূর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছিল ওস্তাদ ইসমাইল খাঁ কে…গম্বুজের পদ্মফুলের চূড়ায় শোভিত এককালের ঐ চাঁদ, শিংযুক্ত স্বর্ণদন্ড…ওর যিনি সৃষ্টিকর্তা…লাহোরের সেই ওস্তাদ কাজিম খাঁ…কোথায় তাঁর অস্তিত্ব বলতে পারেন…? আর ঐ ষাঁড়, বলদে টানা শয়ে শয়ে গাড়িগুলো… বেলুচিস্তান, পারস্য, মাকরাণ,রাজস্থান থেকে আনা দুষ্প্রাপ্য পাথর বোঝাই করে পশুগুলোর পিঠে চাপিয়ে কিরকম নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল দূর দূরান্ত দিয়ে সম্রাটের প্রেমের সৌধ গড়ে তুলতে…যে হাজার হাজার লোকগুলোকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন কপিকল ঠেলে ঠেলে পাহাড় প্রমান পাথরগুলোকে গাঁথার কাজে…সাধারণ মানুষের চোখে আজও তারা অবহেলিত, সম্রাট নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিষ্পেষিত…জনতা আসে, অখন্ড সৌধের অনুপম রূপ দেখে চলে যায়…কজন শুনতে পায় প্রেমের ফলকে হাহাকারের কাহিনী…. শুধু এই চাঁদনি রাতে এমন একাকী মুহূর্তেই মানুষকে শোনাতে চায় ওরা, ভগ্নস্তূপের স্তরে স্তরে চাপা পড়ে থাকা নিজেদের কাহিনি…শুনতে পাচ্ছেন নাকি?’
চমকে উঠে দেখলাম অদ্ভুত দৃষ্টিসম্পন্ন লোকটা কখন এসে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আমার। সাদা চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো হাওয়ায়।
‘ কী দেখছেন জাঁহাপনা? চাঁদনি রাতে পুষ্করিণীর জলে তাজের প্রতিবিম্বিত ছায়া? এককালের গাছপালার অতিপ্রাচুর্য, সুদৃশ্য ঝরনার নীচে নীচে শোভিত বিশালাকৃতির স্বর্ণপাত্র, যমুনার জলধারা সিঞ্চিত সে সব জলাধার, হস্তচালিত গম্বুজাকৃতির কপিকল, পাথরের গায়ে গায়ে পারস্য মধ্য এশিয়ার দূষ্প্রাপ্য টার্কোয়াজ, ল্যাপিস লাজুলি, আফগানিস্তানের বৈদূর্যমণি সমন্বিত পিয়েত্রো দুরার সে অপরূপ কারুকার্য…. ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের অবশেষটুকুর মতোই সেসবই এখন ইতিহাসের গর্ভে..প্রধান সমাধিস্থল সৃষ্টির পাঁচ বছর পর তৈরি সম্রাটের হাতে গড়া ঐ সাজানো বাগান, সেও তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে। এখন যে উদ্যান চোখের সামনে ভাসছে, এ নেহাৎই সেদিনের। ইংরেজের দল নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ভেঙে চুরে বিলিতি গার্ডেনের আনুষ্ঠানিক ছাঁচে একে গড়ে তুলেছে। কিন্তু পুষ্করিণীর জলের ঐ ছায়া…সে তো আর মিথ্যে হতে পারে না। ছায়া আজও ঘুরে ফিরে বেড়ায়..এ সৌধের কোণায় কোণায়, অলিন্দে অলিন্দে… প্রেম, অমরত্বের স্মৃতি, হাহাকার ফিরে ফিরে আসে রাতের নির্জনতার পথ ধরে….যমুনার অবশিষ্ট জল আজও রক্তাক্ত হয়ে রয়েছে হাজারো স্থপতির কেটে দেওয়া বৃদ্ধাঙ্গুলের চুঁইয়ে পড়া রক্তে…।’
মার্বেলের গায়ে হাত রেখে বোধহয় ইতিহাসের সেই নির্যাসটুকুই অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম গুলাম মহম্মদের চোখ দিয়ে।
একটু কৌতুহলী হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’ তুমি কোথায় থাকো?’
‘কেন এখানেই থাকি।’
‘ এখানেই থাকি বলতে?’
‘ এটাই তো আমার পৃথিবী। লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা…এ আমার পূর্বপুরুষের জীবিকা। নিশুত রাতের রহস্যে মাখা গা ছমছমে এই পরিবেশ, এই শান্ত সমাহিত অপার্থিব সৌন্দর্যে ঢাকা চারিধার…এ ছেড়ে আমি যাবো কোথায়? ঐ যে দূরে, তাজমহলের দেওয়াল বেষ্টনীর বাইরে বেলে পাথরের সমাধিগুলো… ওর একটা শাহজাহান পত্নী মমতাজের পরিচারিকাদের সমাধি সৌধ আর বাকীগুলো সম্রাটের অন্য পত্নীদের স্মৃতিবিজড়িত সৌধ। মমতাজকে হারাবার পর ওদেরকে নিকা করেছিলেন সম্রাট। সে প্রেম কি তাহলে ছিল আসলে দ্বিচারিতা? তা আমি জানি না। পূর্বদিকের ঐ লালপাথরের বিশালাকৃতির ইমারত যা এককালে জাওয়াব মানে মেহমানদের থাকার ঘর বা অতিথিশালা বলে পরিচিত ছিল, তার পার্শ্ববর্তী কালো পাথরের মেঝের ছককাটা ঐ মসজিদ….
তাজমহলের এই মীনার চত্তর…এখানে রোজ নমাজ পাঠ হয়, আজান হয়। আমি আজান দিই। কাক ডাকা ভোরে শ্বেতপাথর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করি নিজের হাতে..এই মর্মর পাথরের গায়ে কোনো কলুষতার কালো দাগ আমি লাগতে দেবো না। যে সৌধ কুহকিনীর রূপে যুগ যুগান্ত ধরে মায়ায় বেঁধে রাখে মানুষকে সে নিজে থেকে কোনোদিনই কলুষিত হতে পারে না। সে তো চায় ধরা দিতে….তার ব্যাথা বেদনা বিষাদ অমলিনতা সবটুকু নিয়ে…. আমরাই শুধু বাইরে থেকে সে অমলিনতার মাঝে প্রেমকে খুঁজে খুঁজে বেড়াই…আপনার মতো কজনই বা পারে এরকম নিঝুম একাকী পরিবেশে ইতিহাসের নিগড়ে এসে পৌঁছাতে…তো এসেই যখন পড়েছেন, অত সহজে কি আর ফিরে যাওয়া যায়?’
‘মানে?’
খিলখিল করে হেসে ওঠে গুলাম মহম্মদ।
‘ মানে আপনি ইতিহাসকে জড়িয়ে ধরলে সেও কি পারে আপনাকে না জড়িয়ে থাকতে? ‘
দূরে আঙুল দিয়ে দেখায় লোকটি…’ ঐ দেখুন আগ্রা দূর্গ। পরিখার আড়াল থেকে তাকিয়ে রয়েছে। সামনে যমুনা। একসময় ছিল ভরা জল প্রবাহিত নদী। মুঘল ইতিহাসে যে নদী ছিল বেহেস্ত বা স্বর্গের নদী। জীবনের শেষ আটটা বছর দূর্গের মুসাম্মন বার্জে বন্দীদশাপ্রাপ্ত একাকী সম্রাট নিভৃতে ঠিক এমনি করেই আকুল নয়নে অবলোকন করতেন প্রিয়তমার স্মৃতি সৌধের প্রতিবিম্বিত ছায়া। আজ সে যমুনা মরা খালে পরিণত প্রায়। রাত আর একটু নিশুতি হলে আস্তে আস্তে ভেসে আসবে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুরের রাজকীয় সে শব্দ, থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি. ..ঐ আগ্রা দূর্গের পথ ধরে…থেমে যাবে তাজমহলের ঠিক দোরগোড়ায় এসে…কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হবে চারিধার। আচমকা ঝুমুর পড়া পায়ের কিঙ্কিণীর আওয়াজ ঘুরে বেড়াতে শুরু করবে তাজ চত্ত্বরের আনাচে-কানাচে দিয়ে সারা অলিন্দ ময়…বাগানের চারিধার…অব্যক্ত প্রেমের অমরত্বের স্মৃতি বুকে নিয়ে….রাত আর একটু গাঢ় হলেই…!’
ইতিহাসের নির্যাস আহরণ করতে করতে হঠাৎই মনে হলো, ভয় দেখাচ্ছে নাতো লোকটা? কি জানি…।
‘আসুন জাঁহাপনা, প্রধান ফটকের ভেতর মূল সমাধি স্থলে প্রবেশ করি আমরা..যে সমাধিস্থল সবচেয়ে প্রাচীন। ১৬৪৩ এর মধ্যে শেষ হয় যার নির্মাণ কাজ। আসুন। ‘
বললেন গুলাম মহম্মদ।
গোম্বুজের নীচেকার ধনুকাকৃতির দরজা দিয়ে ভেতরকক্ষে প্রবেশ করে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছি। দেওয়াল ময় অপরূপ সব কারুকার্য। পিয়েত্রো দুরা শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন যে শিল্পীর হাতে গড়া, পৃথিবীতে স্বর্গের অমরত্বকে প্রতিষ্ঠা করতেই যেন তার জন্ম। আমি প্রাণভরে উপভোগ করছি সে ভাস্কর্য, চিত্র শৈলীর আশ্চর্যময়তা। মাথার উপরিভাগে গম্বুজাকৃতি চূড়া থেকে নেমে এসেছে এক প্রকান্ড ঝাড়বাতি। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারীর মাঝে নির্জন নিভৃত কক্ষে যেন এক অপার্থিবতা, অন্য কার অস্তিত্ব ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করেছে আমায় যা এতক্ষণ টের পেলেও নিজের মধ্যে হয়তো অনুভব করিনি এতটা…!
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলাম মহম্মদ বললো,’ এসব খোদাইকার্য চিরঞ্জিলালের মস্তিষ্ক প্রসূত। ওঁরই হাতে গড়া। পাথরের খাঁজে খাঁজে কত যে মণি মানিক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো সেদিনের এই কক্ষ…আজ আর অবশিষ্ট নেই কিছুই। আসল ঝাড়বাতি… ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের সময় সব খুলে নেওয়া হয়েছে। যেটা দেখছেন, এ বাতি কায়রো জাদুঘর থেকে আনানো। লর্ড কার্জনের আনুকুল্যে। এমনকি এই প্রাচীণ গোম্বুজের উপরিতলে চূড়ার একেবারে মাথায় যে স্বর্ণদন্ডটি একদা স্বর্গের অনুপম আলো হয়ে লোকচক্ষে দৃশ্যমাণ হতো, আঠারো শতকের পর আর কেউ সে দন্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বর্তমানে যেটি রয়েছে সেটি কাঁসা অথবা তাম্র নির্মিত কিছু একটা হবে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কক্ষে আলো জ্বলছে না কেন?’
হা হা করে এবার হেসে উঠলো গুলাম।
‘ কে জ্বালাবে? লোক কোথায়?’
‘ মানে? কেয়ারটেকার থাকে না?’
‘ এখন এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কেউ এখানে থাকে না। আবার সবাই আসবে ভোর হলে। কবরের তলায় ঘুমিয়ে আছে যে ইতিহাস, তাকে জাগানোর সাধ্য বা সাহস কোনোটাই ওদের নেই। বুঝলেন কিছু?’
মনে হলো যেন স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে গুলাম। মুখটা কেমন যেন অন্ধকারে ঢেকে আছে ওর। আলো কম বলেই কি?হবে হয়তো। ততক্ষণে আমাকে প্রবলভাবে টানতে শুরু করেছে ঐ ওপাশে সুরঙ্গের মতো নেমে যাওয়া একটা গহ্বর।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গুলাম আমায় স্মরণ করিয়ে দিল, ‘ চলুন জাঁহাপনা, এবার ঐ গহ্বর ধরে মূল সমাধি কক্ষে প্রবেশ করি। সেখানে প্রবেশের আগে অবশ্য আরো কয়েকটি কক্ষ পড়বে। প্রধান কক্ষে দুটি অমর স্মৃতি ফলক রয়েছে। সম্রাট, সম্রাগ্যির নামাঙ্কিত। তার এক স্তর নীচে অপরূপ নকশায় সুসজ্জিত পাশাপাশি দুটো শ্বেতশুভ্র সমাধি বেদি আজও একই রকম অমলিন। সেখানে অনন্ত শয্যায় শায়িত সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর পরম প্রিয়তমা পত্নী আন্জুমান্দ বেগম। খুব অন্ধকার কিন্তু। অনেকটা গভীর সুড়ঙ্গ। পারবেন তো নামতে?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। চলো’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাটা বলে এগিয়ে গেলাম আমি সুড়ঙ্গ পথের দিকে।
ঘন অন্ধকার গহ্বর। আন্দাজে বুঝতে পারছি ছোট ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে একেবারে সমাধি কক্ষ পর্যন্ত।
‘ আসুন। দেখে আসুন।’ বলে আমার সামনে দিয়ে গুলাম নেমে গেল এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে।
একটু একটু করে সিঁড়ি ভাঙছি আমিও।
‘গুলাম। গুলাম। একটু আস্তে চলো। আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছু। গুলাম…!’
কোনো সাড়া পেলাম না কারো। কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা? প্রথম থেকেই ওর চলন বলন হঠাৎ হঠাৎ কিরকম যেন সন্দেহের উদ্রেক করছিল মনে। এবার সেই সন্দেহটা যেন বেড়ে গেল বহুগুণ। এই নিকশ কালো অন্ধকারে, মাত্র কিছুসময়ের মধ্যে কোথায়ই বা হারিয়ে যেতে পারে বৃদ্ধ লোকটা! যতই এপথ ওর নখদর্পণে থাকুক। এই পরিস্থিতিতে, এত কম সময়ে, এত তাড়াতাড়ি পথ চলা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব?
‘ গুলাম..!’
জোড় গলায় চেচিঁয়ে উঠলাম। চিৎকারের শব্দটা ভেতরের কোন্ গভীর অতল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো মাত্র।
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোথায় দাঁড়িয়ে পড়েছি জানি না। ঘন কালো ছাড়া আর কোথাও কোনো রং নেই চারিপাশে। তবে বেশ বুঝতে পারছি এই সুড়ঙ্গ পথ আরো গভীর সুড়ঙ্গের দিকে নেমে গেছে। কতটা গভীর তা আমি জানি না।
……’ টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ…..চিঁহি চিঁহি চিঁহি..!’
অনেকদূর থেকে আসা একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ। সেই সঙ্গে থেকে থেকে হ্রেষাধ্বনি…!
আমি কাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। কান খাড়া করে শুনছি শব্দটা।
স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে একসময় তাজমহলের প্রধান ফটকের একেবারে সামনে এসে থেমে যায় শব্দটা।
মিনিট কয়েক সব চুপচাপ। হঠাৎই আমার কানে পরিষ্কার ভেসে এলো ঝুমুর পড়া একটা মেয়েলি পায়ের আওয়াজ। সুড়ঙ্গপথ ধরে গভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে এক পা একপা করে এগিয়ে আসছে সে শব্দ… আমারই দিকে। সেই সঙ্গে বিনিয়ে বিনিয়ে একটা হালকা নারীকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ।
কে যেন উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে, বুক চাপা কান্না সাথে নিয়ে …ধাপে ধাপে….একপা… একপা…একপা…!
ঐ হ্রেষাধ্বনি, ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ, নারীকণ্ঠের বুকচাপা কান্না,ঝুমুরের শব্দ…যেন কোন্ অদৃশ্যলোকের পথ ধরে নিকশ অন্ধকারের মাঝে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে আমার চারিপার্স্বস্থ পৃথিবীকে। বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যাচ্ছে আমার। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে চলেছি সেই ভয়াল, ভীষণ অন্ধকারকে বিদীর্ণ করতে….দিশেহারার মতো এধার ওধার তাকাচ্ছি শুধু একটু আলো যদি কোথাও পাই….একফোঁটা আলোর রেখা…!
‘ গুলাম..!’
ডাকটা আবার বেরিয়ে এলো কন্ঠনালী চিরে যেন।
….’ হা হা হা হা…’
হঠাৎ….হঠাৎই নীচেকার গভীর সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা পুরুষ কন্ঠের এক প্রবল অট্টহাস্যে যেন ফেটে পড়লো চতুর্দিক। কি নিষ্ঠুর,কি নির্মম, কি ভয়ানক সে হাসির সুর…!
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি ওপরে উঠতে।
আচমকা নীচ থেকে উঠে আসা একটা কার হাত এসে চেপে ধরলো আমার পায়ের কাছটা। যে হাত কোনো রক্তমাংসের হাত নয়। শুধু কয়েকটা হাড়ের সমষ্টিমাত্র।
ঘুমটা ভেঙে গেল ঠিক সেই সময়। চোখ মেলতেই দেখি জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। কাজের লোক রতন চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার আগ্রা ভ্রমণের তরতাজা স্মৃতি যে এইভাবে ফিরে আসবে স্বপ্নের পথ ধরে…বুঝতেই পারিনি!