‘শুভ জন্মদিন বাবা। দেখো, তোমার জন্য একটি গোলাপ ফুল এনেছি।’
হুইল চেয়ারে বসা অসুস্থ বাবার দিকে এগিয়ে এসে কথাটি বললো সৌরভ। ফুলটি হাতে পেয়ে বাবার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল। মুখে কথা বলার শক্তি যদিও নেই তবুও চোখের ইশারায় সৌরভের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করল বাবা। এই অসুস্থতা এক দিনের নয়। কয়েক বছর ধরেই এই অচলাবস্থা। প্যারালাইসিস এর জন্য হাত-পা অবশ হয়ে গেছে যদিও তবুও হাত বাড়িয়ে সৌরভের মাথায় ছুয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল বাবা। আহ্লাদে সৌরভও কমলার জুস বাবার মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘দুনিয়ার সমস্ত হীরে-সোনার খনিও যদি তোমার সামনে এনে রাখি তবুও কি তোমার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো?’
কথাটা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল সৌরভ। যে বাবাকে আজ সে খাইয়ে দিচ্ছে সেই বাবার জন্যই তার দ্বিতীয়বারের মতো পৃথিবীর আলো দেখা। এই লোকটার জন্যই এখনো তার শরীরটা মাটির সাথে মিশে যায়নি। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা এখনো মনে হলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। টানা দু’বছর হাসপাতালের বেডে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। স্পষ্ট মনে পড়ে। বাবার জন্য যে হুইলচেয়ার টা আজ বরাদ্দ হয়েছে সেটি মূলত তার ভাগ্যেই জুটেছিল। বাবা নিজের হাতে কিনতে বাধ্য হয়েছিল তার আদরের ছেলের জন্য। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে প্রথমদিকে সৌরভ কে নিয়ে ভালো কোন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেনি। কিন্তু আশেপাশের এমন কোন ডাক্তার বাকি ছিল না যেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। শেষমেষ অবস্থার অবনতি ঘটলে পালের গরু বাছুর পর্যন্ত বিক্রি করে অপারেশনের টাকা সংগ্রহ করেতে দ্বিধাবোধ করেননি এই লোকটি। পরবর্তীতে সৌরভ তার মামার কাছ থেকে শুনেছে যে তার বাবা নাকি তার চিকিৎসার জন্য বাড়ির ভিটাটুকুও বন্ধক রেখেছিল। সেই স্মৃতিগুলো এখনো হৃদয়ে দাগ কাটে। অসুস্থ থাকাকালীন সৌরভ দেখেছে তার বাবা কিভাবে সারারাত না ঘুমিয়ে কাটাত আর সকাল হলেই রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে পরতো। দিনের শেষে যখন বাড়ি ফিরতো তখন সৌরভের জন্য নানান ফলমূল কিনে নিয়ে আসতো। তারপর নিজের হাতে সেগুলোকে মুখে তুলে দিয়ে খাওয়াতো। প্রচন্ড ব্যাথায় যখন সৌরভ কাতরাতে থাকতো তখন তার বাবা তাকে কোলে তুলে নিয়ে দিঘির পাড়ের ওই আকাশটাকে দেখাতো। স্বপ্নময়ী পাখিরা যখন ডানা মেলে আকাশে উঠত তখন তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতো, ‘ওই আকাশের পাখিগুলোকে একবার দেখো সৌরভ, একদিন তুমিও ওদের মতই আনন্দে বাঁচবে।’
বাবার কথাই সত্যি হয়েছে। সৌরভের দুঃখগুলো মিশে গেছে দিঘির জলের সাথে। আর সুখগুলো পাখির ডানায় ভর করে ফিরে এসেছে তার খাঁচায়। এখন সে একজন নামকরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। কত সম্মান নিয়ে সে এখন বেঁচে থাকে! দেশ-বিদেশের কত মানুষের সাথে তার পরিচয়! কত মানুষ তার একটি অটোগ্রাফ এর জন্য লাইন ধরে থাকে। বড় মাপের লেখক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। কতই না এ্যাওয়ার্ড এসে জড়ো হয়েছে নিজের ঝুলিতে। আহা! সেসব কথা মনে হলেই চোখের কোণে অশ্রুরা এসে টলমল করতে থাকে। এসবের পেছনে যে লোকটি ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিল সেই লোকটিই তার বাবা। আজ তার বাবার ৬৫ তম জন্মদিন। কাল সকাল হলেই সৌরভ তার বাবাকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য। তার বাবার জন্য সে পুরো পৃথিবীটাকেই তছনছ করে ফেলতে পারে তবুও এত্তটুকুনও ক্লান্ত হবে না। আজ পুরো দিনটি শুধু বাবার জন্য। বাবার কানে সৌরভ হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বাবা, চলো আমরা দিঘির পাড়ে যাই।’
প্রথম বর্ষ,
ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং,
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)।