ভোরের গাছপালায় ভিজে ভিজে ভাব। পাতায় পাতায় মুক্তোর মতো জলবিন্দু জানান দিচ্ছে স্বল্পকালের হেমন্ত এখন এই যান্ত্রিক শহরের বুকে বিরাজমান। এই সময়টা আমার খুব প্রিয়। শীত বলে আমি আসছি–আমি আসছি।রাতের দিকে বেশ বেশ একটা শিরশিরানি রোমাঞ্চকর অনুভূতি। স্কুলের পুজোর লম্বা ছুটি শেষ হয়নি।কি করব তাই ভাবছিলাম। বিরাটি স্টেশনে পুরানো বন্ধুবান্ধব মিলে জমিয়ে আড্ডার মাঝে চায়ের ধূমায়িত কাপে তুফান তুললাম আমি–‘চল যাই সমুদ্রমন্হনে।‘ এ আবার কী রহস্য?–কয়েক জোড়া চোখের প্রশ্নবাণের উত্তরে সাহস করে বললাম, চল,ছুট লাগাই বঙ্গোপসাগরের তীরে। কালো ধোঁয়ার শহরের যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে কোথাও গিয়ে নির্মলবাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে সবাই ছটফট করছিলাম।ফলে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল সবাই। কাজেই পরেরদিন খুব ভোরে যাত্রা শুরু। আমাদের গন্তব্যস্হল সাগরদ্বীপ সহ ফ্রেজারগঞ্জ ও চিরপরিচিত আট থেকে আশির স্বপ্নপূরণের আদর্শঠিকানা বকখালি।সফর সূচি ২দিনের। বাড়তি পাওনা হেনরি আইল্যাণ্ড–ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ৫–১২মিনিটের শিয়ালদহ—নামখানা লোকালের টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলাম। জানলার ধারে কিছু সময়ের জন্য সিট পেলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল,ভীড় খুব বেশি নয়। বালিগঞ্জ,গড়িয়া, সোনারপুর ছাড়িয়ে গাড়ি যত এগিয়ে চলে মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মাঝে একটু চা পর্ব সংক্ষেপে সারলাম। মল্লিকপুর–সুভাষগ্রাম পেরিয়ে নজরে আসছে সবুজের সমারোহ।উদার আকাশে মেঘেদের আনাগোনা। পূর্ব দিকে সূর্য উঠেছে, কাঁচা সোনার রঙ ছড়িয়ে। চারিদিকে প্রকৃতি অপরূপ রঙের খেলায় মেতেছে। আকাশের এই দিগন্তবিস্তৃত উপস্থিতি আমার চোখে ভারী নতুন লাগে। একেএকে বারুইপুর,ধবধবে,বহুড়া, জয়নগর,মজিলপুর পেরিয়ে লক্ষীকান্তপুর স্টেশনে পৌঁছলাম। লক্ষীকান্তপুর পেরোতেই দু–দিকের প্রকৃতি দ্রুত পাল্টে যেতে লাগলো। ভীড় কমে গেছে অনেকটাই। চলন্ত ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দু‘দিকে দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধান ক্ষেত , মধ্যে– মধ্যে সবুজ সবজির মাঠ। এ যেন এক সবুজের উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলেছি। জীবনানন্দের রুপসী বাংলার উজাড় করা রূপ। গাছ–গাছালির মাথায় সকালের রোদ এসে পড়েছে, বেশ লাগছে। গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে গৃহস্হের নিকানো দাওয়া, ধানের গোলা,তুলসীমঞ্চ আর গোয়ালঘর। পাশের পুকুরের জল পান্না–সবুজ।চারপাশটা ঘিরে রয়েছে কলমী শাকের বন।ইশ! শহরের কৃত্রিমতা ছেড়ে যদি এখানে, এই মনোমুগ্ধকর সবুজ প্রকৃতির মাঝে থাকতে পারতাম। উপচে পড়া শস্যক্ষেতের মাঝে মনটাকে ছুটিয়ে দিতে না—দিতে এসে পড়লাম এবার নামার পালা। ঘড়িতে ৭টা ৩০।
কাকদ্বীপ স্টেশন
স্টেশন থেকে টোটোয় করে পৌঁছলাম লট নং৮– হারউড পয়েন্টের ভেসেল ঘাটে। কিছু বাদে ভেসেল ছেড়ে দিল। এক সঙ্গে ৩০০ জন মানুষ পার হচ্ছি। এছাড়াও ছোট–বড় গাড়িও ভেসেলে করে পার হয়।নদীর মাঝে মাঝে দেখলাম বড় বড় বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার জন্য পিলার । সাগরদ্বীপের বৈদ্যুতিক যোগাযোগ স্হাপন হয়েছে কাকদ্বীপের মূল ভূখণ্ড থেকে। বড়তলা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই ওপারে পৌঁছলাম ,কচুবেড়িয়ায়।সময় লাগলো ৪৫ মিনিট। এবার গন্তব্যস্হল কপিলমুনির আশ্রম। কচুবেড়িয়া থেকে দূরত্ব ৩১ কিমি। ম্যাজিক গাড়িতে করে রওনা দিলাম। চওড়া মসৃণ রাস্তা। নানা জনপদ ছুঁয়ে এগোতে লাগলাম। রাস্তার দুপাশে সবুজ প্রকৃতি দু‘বাহু জড়িয়ে ধরে আমাদের আলিঙ্গন করতে চাইছে। পথে পড়ল সাগর কলেজ,তারপর রূদ্রনগর।মাছ,পান,সবজি উৎপাদনে উন্নত সাগর দ্বীপ। কৃষিপণ্যের উপর নির্ভর এখানকার মানুষ। কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি ।তবে শিক্ষার হার খুবই ভালো। মানুষ পরিশ্রমী।২০০৯ এর–আয়লায় বেশ কিছু এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল,তার ক্ষত আজো রয়ে গেছে। জনসংখ্যা ২ লক্ষের বেশি। বেশ কিছু বাজার দেখলাম। গাড়ি চলছে মনজুড়ে শুধুই পবিত্র তীর্থস্থান সাগরের কপিলমুনি ও রূপালী বেলাভূমি।দ্বীপ ও নদীনালার দেশ সুন্দরবন অঞ্চলের বৃহত্তম দ্বীপ সাগর দ্বীপ।গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থল তীর্থভূমি গঙ্গাসাগর। এখানকার বেলাভূমি বকখালি–ফ্রেজারগঞ্জের তুলনায় কম আকর্ষণীয় নয়। ছোট–বড় ৫১টি দ্বীপ নিয়ে আনুমানিক ২২৪ বর্গ কিমি জুড়ে সাগর দ্বীপ। দক্ষিণ ২৪পরগনার একটি সুপ্রাচীন ব্লক। চারিদিকে মাটির বাঁধ দিয়ে বেষ্টিত। গঙ্গার মর্ত্যে আসা ও সগর রাজার পুত্রদের জীবনধারনের লোকগাঁথা কে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই তীর্থস্থান। কপিলমুনির আশ্রমটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা নতুন কপিলমুনির আশ্রম ও মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে ভক্তসমাগম হয় মকরসংক্রান্তির পূণ্য তিথিতে।লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড় জমে এই সঙ্গমে। মিনি ভারতের রূপলাভ করে।মেলার সময় বাদ দিয়ে গঙ্গাসাগর নিরালয়, নির্জন বেলাভূমি। মন্দিরের সামনে থেকে নির্জন বালিয়াড়িটি সোজা গিয়েছে সমুদ্রে। এখানে সমুদ্র ঢেউ ভাঙে না। তির তির করে এগিয়ে এসে চরণযুগল ভিজিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় সমুদ্রের ভিতরে। এই সব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম সাগর তীরে অবস্থিত কপিলমুনির আশ্রমে। নিতান্তই মধ্যবিত্ত মানসিকতার অথচ পরিস্কার –পরিচ্ছন্ন নির্জনতার ছোয়ায় ভরা একটি রিসোর্টে উঠলাম। অসাধারণ আপ্যায়ন।ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন , খাওয়ার মেনু কি হবে? ইলিশের মরশুম না হওয়ায় আমরা চিংড়ি,কাঁকড়া আর পাবদা মাছের অর্ডার দিয়ে রুমে নিজেদের জিনিসপত্র রেখে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম।তখন সকাল ১০টা। গঙ্গাসাগরের প্রেমে পড়ে গেলাম।‘সবতীর্থ বার বার/গঙ্গাসাগর একবার ‘। কথাটা হৃদয়ের মাঝে অনুরণিত হতে লাগলো। শুধু সমুদ্র সৈকত নয়, এখানকার নিসর্গকে উপভোগ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে । শুনেছি ,পঞ্চতীর্থের শ্রেষ্ঠতীর্থ বলাহয় গঙ্গাসাগরকে। সাগরে স্নান করলে পূণ্য সঞ্চয় হয়। ভারতের অসংখ্য নর–নারী পথের বাধা অগ্রাহ্য করে মুক্তির আশায় সাগর সঙ্গমে স্নান করে গেছেন। বহু প্রচলিত পুরাণ কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে সাগরের কপিলমুনি আশ্রম। ইতিহাস আর পুরাণের নীরব সাক্ষী এই বেলাভূমি। মনে পড়ে গেল ভগীরথের গঙ্গাআনায়ন বৃত্তান্ত। এক সময়ে ক্লাসে পড়াতাম এই বিষয়ের একটি প্রবন্ধ। পায়ের পাতা ভেজানো জল থেকে হাঁটু জলে নেমে এসেছি।নিরাপদে স্নান সারলাম। অবাধে খেলে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়া। পিছনে পিছনে আমরা যেই যাচ্ছি ,মুহূর্তে আমাদের আগমন টের পেয়ে গর্তে ঢুকে গেল।এ এক অন্য পৃথিবী। দূর দিগন্তরেখায় একটা–দুটো–তিনটে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার দেখলাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্যজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম চোখে পড়লো। জীবন ধারণের একমাত্র উৎসভূমি এই অনন্ত জলরাশিময় সাগর।জীবন–মরণের কেন্দ্রভূমি। পেটের তাগিদে সমুদ্রের ডাক অস্বীকার করার উপায় নেই। বাচ্চাদের মতো ঢেউ–এর সাথে ছোঁয়া ছুঁয়ি আর বালি নিয়ে খেলা শুরু করলাম। মূহুর্তে যেন আমরা সোনালী শৈশবে ফিরে গেছি। এবার ঝিনুক কুড়াতে লাগলাম।এই দৃশ্য দেখে বোম্বা বলে উঠলো–‘বুড়ো বয়স ভীমরতি ধরেছে।‘ মনে পড়ে গেল একটি কালজয়ী গানের কলি” এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না/যাতে মুক্ত আছে“। শুধু মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে দেহ–মনে। দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র আর ঢেউ–এর গর্জন, অপার স্নিগ্ধতা ধুয়ে মুছে দিল নাগরিক জীবনের সমস্ত ক্লেদ আর ক্লান্তি। ঢেউয়ের তালে তালে এত অজস্র ছোট–বড় ঝিনুক সত্যিই অন্য কোন বেলাভূমিতে তেমন ভাবে মেলে না। মনে হলো সমুদ্র মানেই তো বাচ্চা ও বড়ো বয়সের সীমারেখা ভুলে জলে লুটোপুটি খাওয়া,জলে ঝাঁপ, এন্তার প্রধান আর ঝিনুক কুড়োনো সমুদ্র এখানে যেন মায়াবী জাদুকর। জোয়ার –ভাটার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম এবং মুগ্ধ হলাম। নরম সূর্যের সোনালী আলো গায়ে মেখে নিলাম।এ–এক অন্যজীবন। নীরব সাক্ষী শুধু অনন্ত জলরাশি। পুরি–দীঘায় কোথাও এমন ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া দেখা যায় না। অনেক টুকরো টুকরো অনুভূতি আর অনেক টুকরো না বলা কথা যেন মেঘের মতো উড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমরা ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম।সময় নষ্ট না করে একটি টোটো ভাড়া করে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে বেরোলাম।মোট ছেচল্লিশটি গ্রামের সমষ্টি এই দ্বীপভূমি। অনিশ্চিত ভবিষ্যত।যে কোন সময় প্লাবিত হতে পারে। সবুজে মোড়া সাগর দ্বীপ। বেশ কিছু মন্দির –মঠ ও সমৃদ্ধ সাজানো গোছানো গ্রাম দেখলাম। তারপর মনসাদ্বীপে রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছলাম , লাইট হাউস ও মোহনা এবং ২০০৯এর আয়লায় ক্ষতি হওয়া কিছু এলাকা দেখলাম। পথে বনবিবি মন্দিরদেখে সামান্য কিছু দূরে যেতেই একটা বড় সামুদ্রিক মাছের বাজার পড়লো, বিচিত্র ধরনের মাছ দেখলাম, সবই সমুদ্র থেকে ধরা। বড় বড় পানের বরোজ দেখে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসলাম সাগর সৈকতে। সাগরের বুকে সূর্যাস্তের অপূর্ব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বহুদিন মনে থাকবে।সেচ বাংলোর পাশদিয়ে যে রাস্তা সমুদ্রের দিকে গেছে তা অসাধারণ। একদিকে ঝাউজঙ্গল। সন্ধ্যার সময় সাগরপাড়ে এসে সবাই বসলাম । বেশ একটু নিরালায়, একদম কোলাহল মুক্ত। ভাগ্য ভালো,তাই পূর্ণিমার রাতটা যেন নতুন মাত্রা যোগ করল। চাঁদের আলোয় সমুদ্র ভারী মায়াময়। একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউয়ের সফেদ জলরাশি রূপোলি আলোয় চিকচিক করে উঠছে।এ যেন এক অন্যরকম পাওয়া,যে প্রাপ্তির কথা ভাষায় প্রকাশ করতে আমি অক্ষম।ভাগ্যিস রবিঠাকুর ছিলেন! তার গান , সেই ছোট বেলা,মানে‘দক্ষিণী‘তে থাকাকালীন সময়ে থেকে আমার সুখ–দুঃখ–আনন্দ –ভালোবাসার সঙ্গী।একের পর এক সবাই গান গাইতে লাগলাম ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক প্রকৃতির। শুধু ঝাউয়ের পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের আওয়াজ।সবাই বিভোর–বিমুগ্ধ।চা মাছভাজা আর পকোড়া সহযোগে আড্ডাটা অনেক রাত অবধি গড়াল। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত চরাচর। পূর্নিমার চাঁদের আলো মেখে পৃথিবীর একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই সৈকত। জনমানবহীন সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নামাখা রূপোঝুরি সমুদ্রের যে রূপ,তার এককথায় অভূতপূর্ব। অনন্ত বালিয়াড়ি শান্ত সমুদ্র এবং উদার শান্ত– স্নিগ্ধ আকাশ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে রূপ বদলায় এখানকার প্রকৃতি । নির্জন বালুকাবেলায় দিন বদলায়। চারিদিকে সুন্দর ছবির মতো গ্রাম। মন ভালো করা সবুজ। ভিড় ও কোলাহল থেকে অনেক দূরে অন্যরকম অবকাশ। দুটো দিন কাটালে মনে হয়,আরও দু‘দিন থেকে গেলে হয়! তাঁর মধ্যে একটা রাত পূর্ণিমা হলে তো কথাই নেই। আমাদের পরম সৌভাগ্য দিনটা ছিল পূর্ণিমা। একেবারেই সোনায় সোহাগা। সামনে অনন্ত জলরাশি। এ–এক অন্যভুবন। ইতিহাস আর পুরাণ মিলেমিশে একাকার।সাগর সঙ্গমে এক নব উপলব্ধি লাভ। বহুদিন মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
সমুদ্রের উচ্ছ্বাস এখানে বেপরোয়া নয়। দূরে আলোর বিন্দু জ্বলছে নিভছে, জানান দিচ্ছে মাছধরা জেলেরা ঘরের পথে ফিরছে। ঢেউগুলো ফিরছে।বালির পাড়ে আছড়ে আবার জলের বুকে ফিরছে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আমি অনেক বার প্রশ্ন করেছি, যে যায় সে কি আর ফেরে? উত্তর মেলেনি। ভারাক্রান্ত মনেফিরে এসে রাতের খাবার পর্ব সারলাম।ম্যানেজারের কাছে থেকে শুনলাম ভগীরথের গঙ্গার –মর্ত্যে আনার কাহিনী। সকালে উঠে সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে আমরা রওনা দিলাম বকখালি–ফ্রেজারগঞ্জের রূপোলি সমুদ্র সৈকতে দিকে।হাতানিয়া–দোয়ানিয়াল নদী সেতু দিয়ে আমাদের ভাড়া করা গাড়ি দূরন্ত গতিতে চলল।বকখালির পথে চলেছি।‘ ডাকছে আকাশ ডাকছে বাতাস ‘ এই গানটি মনে পড়ে গেল।কারণ বকখালির উন্মুক্ত আকাশ, আসলে আকাশ তো উন্মুক্তই তবে আমরা যারা শহরের মানুষ,হাইরাইজের ভিড়ে একটুকরো জ্যামিতিক চতুষ্কোণ আকাশ দেখে থাকি তাদের চোখের আরাম মনের শান্তি,বকখালির আকাশ অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং প্রাঞ্জল। রাতের তারাভরা নীলাকাশের নির্জনতার নাম বকখালি।।অল্প সময়ে পৌছে গেলাম বকখালি। চারিদিকে ঘুরে দেখার জন্য একটি ভ্যান ভাড়া করলাম। বাইশমাথাওয়ালা খেজুর গাছ দেখতে পাড়ি দিলাম ভ্যানে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ফিরে এলাম সমুদ্র সৈকতে। শান্ত নির্জন সমুদ্র, নির্ভেজাল নির্জনতা,শব্দরা যেখানে হারিয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ নেই বললেই চলে।তবে বকখালির সি বিচের এক আশ্চর্য মহিমা দূর থেকে দেখলে মনে হবে লাল কার্পেট বিছানো,অথচ সামনে যাওয়া লাল কার্পেট ভ্যানিশ। কেবলই বালুকাবেলা। দিনভর লাল কাঁকড়ার পিছনে ছোটাছুটিতে এক নির্মল আনন্দ পেলাম । দূরত্ব ৩০কিমি নামখানা থেকে ।বকখালি ঘুরে ফ্রেজারগঞ্জে গেলাম। বকখালির অদূরে এক মনোরম বেলাভূমি ফ্রেজারগঞ্জ। স্যার আ্যন্ড্রুজ ফ্রেজার বাংলার ছোটলাট(১৯০৩–১৯৭৮)সালে এই জায়গাটি আবিষ্কার করেন। জনশ্রুতি রয়েছে হঠাৎ এক জাহাজ দুর্ঘটনায় তিনি ওখানেই আসেন এবং স্হানীয় এক মহিলা যার, নাম নারায়নী তার সেবাযত্নে তিনি বেঁচে ওঠেন।ফ্রেজার সাহেব ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়েন। সেই সময় জায়গাটির নাম ছিল নারায়ণতলা।
পরে নামকরণ হয়ফ্রেজারগঞ্জ তার নিরলস চেষ্টায় সমুদ্র গড়ে ওঠে সৈকত নগরী। এরপর ভ্যানে চললাম হেনরি আইল্যাণ্ড–ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দিকে । ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমগ্র সুন্দরবনের অপূর্ব নৈসর্গিক প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সুগভীর ও বিস্তৃত অরণ্য। ভিতরে ৫০টি পুকুর রয়েছে মাছ চাষের জন্য। গেস্টহাউস আছে তিনটি। গাছের সঙ্গে নাম মিলিয়ে সুন্দরী,বানীও ম্যানগ্রোভ।ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে বকখালি সি বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বারবার মনে হচ্ছিল কতকাল আগের ফ্রেজার সাহেবের সৈকতনগরী আজও ইতিহাসকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। যদিও সাহেবের বাংলোটি আজ আর নেই। বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির দর্শন করলাম। তারপর ক্রোকোডাইল পার্কদেখে নানান ধরনের মাছভাজা খেলাম।একটা স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো জম্বুদ্বীপের নৌকা ভ্রমণ। ।মুগ্ধ হলাম দুটো সমুদ্র সৈকত দেখে। লাল কাঁকড়ার স্বর্গ রাজ্য সুন্দর এই বেলাভূমিতে তৈরি হয়েছে মৎস্য–বন্দর, হয়েছে মৎস্য দপ্তরের নানা ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। শুনলাম, শীতের সময় ফ্রেজারগঞ্জ থেকে সমুদ্র বিহার করে ঘুরে আসা যায় জম্বুদ্বীপে–এ। বেতার,ইরান, কেওড়ার বনে ছাওয়া জম্বদ্বীপ হরিণ,শুয়োর, বিষধরসাপ আর পাখীদের স্বর্গরাজ্য। প্রকৃতির অকৃপণ আশীর্বাদ ধন্য এই দ্বীপের একমাত্র আকর্ষণ শুঁটকি মাছের বিকট গন্ধ।স্হানীয় মানুষের কাছে জানলাম এখানে একটি বনবিবির মন্দির আছে,আর আছে পরিত্যক্ত এক লাইট হাউসও। নানান ধরনের স্মৃতি নিয়ে দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম বেশ দেরি করেইএবং সি –বিচের–ঝাউজঙ্গল ঘুরে, সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলাম সবাই। কুয়াশার চাদর জড়ানো সৈকতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে সাতরঙা রামধনুর রং ছড়িয়ে কুসুমরঙা দিবাকরের পূর্ণ চ্ছটা ।কী যেন এক অপার্থিব পাওয়ার আনন্দ সারা শরীরজুড়ে।আর মুগ্ধনয়নে দেখছিলাম দিনান্তের রবিকে একমুঠো আবির ছড়িয়ে দিগন্তে বিলীন হয়ে যেতে।বড় মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য।আর চাঁদনি রাতে সৈকত যেন রুপোর পাতে মোড়া সঙ্গে চিকমিক বালি আর শ্বেতশুভ্র ঝিনুক যেন জারি চুমকির মতো ফুটে রয়েছে। বহুদিন মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। দু‘দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পাড়ি দিলাম নামখার দিকে। নানা জনপদ ছুঁয়ে এগোতে লাগলাম গাড়িতে করে।অমলিন সমুদ্র দর্শনের স্মৃতি বুকে নিয়ে রাতেই ফিরলাম নামখানা রেল স্টেশনে।রাত ৮টার লোকাল ট্রেনে চেপে রওনা কোলকাতার উদ্দেশ্যে। দুদিনের সমুদ্রমন্হণের অমলিন স্মৃতি বুকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছলাম বিরাটিতে। পিছনে পড়ে রইলো দু‘দিনের সমুদ্রমন্থনের মনোমুগ্ধকর কিছু স্মৃতি। পথনির্দেশ–কোলকাতা থেকে দূরত্ব ১৩২কিমি।ট্রেনে নামখানা। নামখানা সেতু দিয়ে বাসে, ছোট গাড়িতে বকখালি । বকখালি থেকে টোটো অথবা ভ্যানে ফ্রেজারগঞ্জ ও হেনরিআইল্যাণ্ড। সরাসরি কোলকাতা থেকে নিজস্ব গাড়িতে মাওয়া যায় বকখালিতে। সরকারি ও বেসরকারি লজ , হোটেল আছে। ভালোমানের কিছু লজ ও রিসোর্ট আছে। সমুদ্রের নানান ধরনের মাছ খাওয়ার সুযোগ আছে। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দপ্তরের ট্যুরিস্ট লজ আছে।হলিডে হোম কিছু আছে। কাছাকাছি ভালো শহর নামখানা, কাকদ্বীপ,ডায়মণ্ডহারবার। নতুন সেতু চালু হওয়ায় অল্প সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় সমুদ্রেরকুলে। আট থেকে