জোবায়ের রাজু
সাত সকালে মায়ের বাড়ি কাঁপানো চিৎকার শুনে আমাদের চোখ থেকে ঘুম নিমিষেই পালিয়ে গেল। কোন অঘটন ঘটেছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে আমি আর বড়দা ঘুমকেতুর চোখে হন্তদন্ত হয়ে দরজায় এসে দেখি মা উঠোনে মামাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে ব্যাকুল গলায় চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। শ্যামা একমনে তার বাগিচার চারাগুলিতে পানি ঢালছে। মা আর মামার কার্যকলাপে তার ভ্রæক্ষেপ নেই।
মামাকে পেয়ে মা আহ্লাদি গলায় বললেন ‘ভাইজান, আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি এখানে। এতকাল পর বোনের কথা মনে হল? ক’দিন আগে স্বপ্নে দেখেছি আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন। কইরে শ্যামা, তোর মামার জন্য চিতই পিঠার আয়োজন কর। আমার ভাইজানের চিতই পিঠা বড় পছন্দের।’ মায়ের কথা শুনে মামা নিরস গলায় বললেন ‘কোন কিছু তৈরী করার দরকার নেই সেলী। এক গøাস পানি দে।’ মা দ্রæত চলে গেলেন পানি আনতে। মামা হাইপাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে আমাদের দু ভাইকে দেখে বললেন ‘তোমরা কেমন আছো?’ বড়দা ছোট্ট করে বলল ‘ভালো।’ বড়দা’র কথা মামার কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। মামা শ্যামাকে বললেন ‘তুমি শ্যামু না? অনেক বড় হয়েছো!’ শ্যামা মামার দিকে না তাকিয়ে গাছে পানি ঢালতে ঢালতে বলল ‘আমি এবার সেভেনে পড়ি।’
এই আমাদের মামা। আমার মায়ের একমাত্র বড় ভাই। নাম কিরণ। নানাজান বেঁচে থাকতে আমরা মায়ের সাথে মাসে দু চারবার নানার বাড়িতে যেতাম। এক আশ্বিনের সকালে নানাজান মারা গেলেন। তারপর থেকে বাপের বাড়ির সাথে মায়ের দূরত্ব। মামি আমাদেরকে সহ্য করতেন না। আমরা গেলে বিরক্ত হতেন। আমরা তখন খুব ছোট্ট, একদিন দেখলাম মা আর মামার তুমুল ঝগড়া। মামা এক পর্যায়ে মায়ের গালে সজোরে কষে এক চড় বসালেন। গুমরে কাঁদলেন মা।
এই ঘটনার পর বাবা মাকে আর ওই বাড়িতে যেতে দেননি। কিন্তু ভাই বোনের সম্পর্কের বন্ধন থেকে মা কি সত্যি বের হয়ে আসতে পেরেছেন? না পারেননি। মাকে প্রায়ই দেখতাম ঘরের কোণে বসে নিরিবিলি কাঁদতে। দূর থেকে যতবার এই দৃশ্য দেখতাম, ততবার ব্যথায় আমার বুকটা টনটন করত।
বড়দা’র মুখে একদিন শুনলাম আমাদের মামার হাল বৃত্তান্ত। বড়দা একদিন ক্ষোভ নিয়ে বলল ‘ওটা মামা নয়রে। ওটা জানোয়ার। আমাদের মায়ের সম্পত্তি লুট করে খাচ্ছে।’ আমাদের দু ভায়ের কথোপকথন শুনতে পেয়ে মা উল্কার মত দৌড়ে এসে বড়দা’র পিঠে কিল ঘুষি মারতে মারতে বললেন ‘হারামখোর, আমার ভাইজানরে এসব বলতে লজ্জা লাগে না?’ বড়দা ক্ষ্যাপা গলায় জবাব দিল ‘ওটা তোমার ভাই নয়। অমানুষ। ওই অমানুষটা আমাদের সামনে তোমার গায়ে হাত তুলেছে। দরদ দেখাচ্ছো কেন?’ মা কোন কিছু না বলে চিৎকার দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। বড়দা আর আমি মায়ের পরিস্থিতি দেখে পাগলের মত হয়ে গেলাম।
রাতে বাবা আমাদের ঘরে এসে বড়দা’কে বললেন ‘তোদের মামাকে নিয়ে কোন বাজে কথা তোদের মায়ের সামনে বলবি না।’
এরপর থেকে বড়দা মায়ের সামনে মামা সম্পর্কে কোন প্রসঙ্গ তুলত না। আড়ালে অবডালে আমাকে শোনাতো আমাদের বজ্জাত মামার জঘন্য সব গল্প। বোনের প্রতি ওই মানুষটার টান থাকা তো দূরের কথা, বরং বোনের ভাগের সম্পত্তি লুট করে তিনতলা বাড়ি করেছে। অথচ নানাজান তার দু সন্তানের জন্য সমান ভাগে সম্পত্তি রেখে গেছেন। আমাদের মাকে সেই সম্পত্তির ভাগ দেয়নি মামা। শুধু এই কারণেই মামা মানুষটা বড়দা’র চোখে চিরকাল বিষ।
আজ এত বছর পর আমাদের বাড়িতে সেই মানুষটার আগমন কেন বুঝতে পারলাম না। মা তার ভাইকে উঠোনে চেয়ার পেতে দিলেন। মামা তাতে নিরস মুখে বসে আছেন। মা তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমরা দুই ভাই বাম দিকে দাঁড়িয়ে আছি। পাশে শ্যামা। সে চুল আঁচড়াচ্ছে স্কুলে যাবে বলে।
মা এত বছর পর ভাইকে পেয়ে নানাজানের টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণ করছেন করুণ গলায়। সেদিকে মামার কর্ণপাত আছে বলে আমার মনে হল না। মামার হাতে একটি সাদা কাগজ। দলিলের মত কি যে দেখাও যাচ্ছে। ডান হাতে একটি পুরণো কলম। বড়দা আমাকে ফিসফিস করে বলল ‘মনে হচ্ছে মায়ের ভাগের সম্পত্তিগুলি দিতে এসেছে।’
মা ক্রমশ তার বাপের বাড়ির বেদনাতুর স্মৃতিচারণে ডুবে যাচ্ছে বলে মামা বললেন ‘সেলী, তোর একটা স্বাক্ষর দরকার এই কাগজটাতে। একটা স্বাক্ষর করে দে বোন। এজন্য এসেছি।’ মা কোন কিছু না ভেবে ভাইয়ের কথা মত দলিল খানায় একটা স্বাক্ষর বসিয়ে দিলেন। স্বাক্ষর শেষে মামার মুখে হাসি দেখা গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বললেন ‘তোর ছেলে মেয়েদেরকে দেখছি। দুলাল কোথায়? বাড়িতে নেই?’ ভাইয়ের কথা শুনে মা কাচুমাচু করে বললেন ‘ইয়ে মানে …।’ বড়দা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল ‘আপনি কেমন ভাই? বোন তিন মাস আগে বিধবা হয়েছে, অথচ আপনি জানেন না!’ চোখ কপালে তুলে মামা বললেন ‘তোদের বাবা মারা গেছে? আমাকে জানালিও না?’ মা শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন।
মামা চলে গেলেন। বোনের কাছ থেকে কিসের স্বাক্ষর নিতে এসেছেন, আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। সাত দিনের মাথায় মায়ের এক আত্মীয়ের কাছে জানলাম নানাজান মায়ের নামে শহরে যে বড় জমিটি লিখে দিয়েছেন, মামা সেটা নিজের নামে করিয়ে নিয়েছেন। সেজন্য দলিলে মায়ের একটা স্বাক্ষর দরকার ছিল। মা না জেনে ভাইয়ের কথা মত চুপচাপ স্বাক্ষর দিয়ে দিলেন।
এই ঘটনা জানার পর বড়দা আন্দোলিত গলায় বলল ‘ওই জানোয়ার এই কাজ করতে এখানে এসেছে জানলে পিটিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দিতাম।’ মা উঠোন থেকে বারান্দায় দৌড়ে এসে বড়দা’র গালে কষে এক চড় মেরে বললেন ‘অসভ্য কোথাকার, আমার সামনে আমার ভাইজানরে এসব বলার সাহস কে দিল তোকে?’ আমি আর শ্যামা পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের মায়ের জীবনটা একটা নাটকের মত কেন? এই নাটকে মা সব সময় মহিয়সী নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, এবং মায়ের সেই অভিনয় অবশ্যই সুন্দর। তারপরও মায়ের এই অভিনয় দেখলে আমার চোখে পানি চলে আসে। কেন, বুঝি না।
আমিশাপাড়া, রাজু ফার্মেসি, নোয়াখালী।