কবিতাঃ ০১
প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত
তুমি চলে যাওয়ার পর
আমার হাতের তালু থেকে নেমে গেছে মহাসড়ক,
আমাদের পাড়ার রাস্তায় উঠে এসেছে তোমাদের ঘরদোর, বিছানাপত্র, সীমানা প্রাচীর এবং তোমরা…
তারপর থেকে সরু হচ্ছে আমাদের পথঘাট; যুগল চলাচল,
গোপনীয় খেলার মাঠও বেদখল করেছে হঠাৎ আগুন্তক।
আমাদের সময়কার সেইসব প্রশস্ত রাস্তাঘাট এখন হাওয়া,
আমি এখন নিয়ম করে হাওয়া খাই;
নবীন এই নগরে আমি যখন যা চাই- পাই,
কেবল তোমাকে আর পাই না!
তোমরা এখন অভিজাত মহল্লায় থাকো; আবাসিক,
তোমাদের প্রবেশদ্বারে লেখা- ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’
এখন আর হুটহাট ভেতরে ঢোকা যায় না
ঢুকতে গেলে পরিচয় লাগে…
পাহারদার পরিচয়পত্র দেখতে চায়
আমার পরিচয়পত্র তোমার বুকের ভেতর সিল মারা
কও তো- এখন সবাইকে কেমনে দেখাবা?
প্রেম মানেই অদৃশ্য এক যন্ত্রণা…
কবিতাঃ ০২
জলাতঙ্ক
রফিকুল নাজিম
পাড়ার মোড়ে
খেলার মাঠে
স্কুলের বারান্দা কিংবা খেয়াঘাটে
শহর থেকে বন্দরে
শহরতলী থেকে প্রান্তজনের মায়াবতী গ্রামে
সর্বত্র চলছে কুকুরের রামরাজত্ব; ঘেউঘেউ!
জলাতঙ্কের আতঙ্কে মানুষগুলো আজ গৃহবন্দী
কুকুরের ভয়ে নারী ও শিশুরা আড়ষ্ট ও জড়োসড়ো।
কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিনের চাহিদাপত্রও জমা দেননি
অথচ এদিকে ভাদ্র মাসও আসি আসি করছে!
কবিতাঃ ০৩
কিয়ামতের তাণ্ডব
রফিকুল নাজিম
পাহাড়গুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে
বিস্তৃত জলরাশি ক্রমশঃ উধাও হয়ে যাচ্ছে
পাখিদের ডানা থেকে খসে খসে পড়ছে শুভ্র পালক,
কোথাও কোনো বৃক্ষ নেই; কোথাও কোনো ছায়া নেই
কোথাও কোনো ফুলও নেই; ফুলের কোনো ঘ্রাণও নেই!
আহা!
তুমি চলে যাওয়ার পর আমার কিয়ামত হয়ে গেছে
ওলট-পালট হয়ে গেছে মায়ার জমিন; তাবৎ পৃথিবী।
নির্লিপ্ত আমি দাঁড়িয়ে আছি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে
অপলক দেখছি- লকলকে টকটকে লাভা হেঁটে যাচ্ছে
মাটির অতল বুক কেবলই গলে গলে যাচ্ছে
ভেতরে ভেতরে দ্রুতই গলে যাচ্ছি আমি।
কবিতাঃ ০৪
সমর্পিত আগুনফুল ও বিবশ যন্ত্রণা
রফিকুল নাজিম
আমি জীবনানন্দ নই
এবং তুমিও বনলতা নও
আমরা আর মুখোমুখি বসি না কোথাও
তবুও আমি জল রঙকে কাগজে খেলাই; খেলি,
তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবিটা আঁকি…
হঠাৎ আমাদের বিচ্ছেদ দিনের দৃশ্যপট সামনে এসে দাঁড়ায়
আমি দেখি- তুমি চলেই যাচ্ছো
অন্য হাতে সঁপে দিয়েছো তোমার আগুনফুল
নীল যন্ত্রণা নিয়েও আমি নির্বিষ সাপের মতো
কেবলই ফুঁসতে থাকি; তবুও দুই দাঁতের দাগ বসাই না,
অতঃপর অঝোর শ্রাবণের আমার চোখ আকাশ হয়ে যায়।
শ্রাবণ চলে গেলে ফের আমি ফুঁসতে থাকি
গোস্বায় আমি আঁকার ক্যানভাস ছিঁড়ে ফেলি,
শুধু তোমাকে আমি ছিঁড়তে পারি না;
তুমি আমার মনের ক্যানভাসে থেকে যাও নীরবে!
কবিতাঃ ০৫
কেবলই রাত হয়ে যায়
রফিকুল নাজিম
একই শহরে আছি
অথচ অনেকদিন আমাদের দেখা হয় না
একই আকাশ তলে আমাদের বিপরীত বসতি
আমরা মুখোমুখি বসি না অনেকদিন হয়
শুধু ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ারগুলো খালি নেই
কেবল আমরা আর কোথাও নেই; এখানে ওখানে
চেয়ারে কিংবা ঘাসে, ক্লাশের বেঞ্চিতে; মুখোমুখি-পাশাপাশি।
এই শহরের অলিগলি ফুটপাত পার্ক এভিনিউ শপিংমল
ফুড কোর্ট নাট্যশালা বাংলা একাডেমি একই রকম আছে
শুধু আমরা আর কোথাও নেই; যুগলে-বগলে।
এখনো শাহবাগের রাস্তা হেঁটে যায় এলিফ্যান্ট রোড
পলাশীর রাস্তা ছুটে চলে চানখারপুল; রিক্সার ক্রিংক্রিং বেল।
পরীবাগ, কাঁটাবন, নীলক্ষেত- যে যার মত ছুটছে
শুধু আমরা আর পাশাপাশি পথ হাঁটি না
এখনো এই শহরে ধুমধাম কাঠগোলাপ ফোটে
এখনো উৎসবে বর্ণিল হয় চারুকলা, টিএসসি, বকুলতলা
কেবল আমাদের জন্য আর কোনো উৎসব আসে না
আমাদের দিনগুলো আর দিন থাকে না
কেবলই রাত হয়ে যায়; রাতগুলো নিকষ কালো হয়ে যায়!
কবিতাঃ ০৬
পূর্ণদৈর্ঘ্য যন্ত্রণা
রফিকুল নাজিম
আজকাল তোমার নাম্বারে কল যায় না
তুমি কি আমারে ব্ল্যাক লিস্টে রাখছো?
ডাকবাক্স ত সেই কবেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
তোমার ঠিকানাও তুমি বদলে ফেলেছো ঋতুর মত।
ইদানীং ম্যাসেঞ্জারে ঢুইক্যা দেহি আমি ব্লকড
ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে আমার প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত!
আচ্ছা- চাইলেই কি মনের মানুষকে ভোলা যায়?
রাত গভীর হলে তুমিও কি বারংবার ইনবক্স চেক করো
মেসেজের অপেক্ষায় তুমিও কি নির্ঘুম রাত পাড়ি দাও
গলাকাটা কবুতরের মত ছটফট করো অস্থিরতায়?
হঠাৎই আমার শূন্যতায় ঠুকরে ঠুকরে কাঁদো?
এসব শুধুই আমার কল্পনা;
নাকি ছেলেমানুষী আবেগের বড্ড বাড়াবাড়ি?
কবিতাঃ ০৭
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ
কবির বুকে চারু ব্যথা
কবি তার বুক ডাক্তারকে দেখালেন
কবির ঠোঁট ও দাঁত দেখে ডাক্তার বললেন,
‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ নিকোটিন ও এলকোহল মৃত্যুর কারণ।’
কবি মুচকি হেসে বললেন, ‘দুর! এইগুলা আজাইরা কথা। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ প্রেমিকার চোখ ও ঠোঁট প্রেমিকের মৃত্যুর কারণ।
আগুনে পুড়লে অন্ততঃ ছাই পাওয়া যায়,
প্রেয়সী যদি পোড়ায় অস্তিত্ব পাওয়া দায়।
কবিতাঃ ০৮
সূর্যালোক, ছায়া ও বিচ্ছেদ
রফিকুল নাজিম
রৌদ্রস্নাত পাতায় খাদ্যের উৎপাদন চলে হরদম
বিশুদ্ধ বায়ুর সনদপত্র লেখে সৌম্য সূর্যালোক
অক্সিজেন আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ইকুইলিব্রিয়াম।
তবুও মানুষ মেঘের প্রার্থনায় কাতর হয়; ছায়া চায়,
ঈশ্বরমুখী গণমানুষ ব্যাঙের বিয়ে দেয়;
বৃষ্টির জন্য ভিক্ষা মাগে।
রৌদ্রের প্রখরতায় একদিন পাশের মানুষও পালিয়ে যায়
গনগনে মধ্যাহ্নে মানুষ কেবল নিজেরই ছায়া খুঁজে পায়।
কবিতাঃ ০৯
জন্মান্তরে শুধু তোমাকে চাই
রফিকুল নাজিম
তুমি আমাকে একবার ডাকলে
চৈতালি হাওয়ার মত আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে যাই
একবার তুমি আমার চোখে চোখ রাখলে
সারা পৃথিবীকে আমার কাছে মনে হয় সরিষার মাঠ;
আউলা ঝাউলা বাতাসে অনুভূতির ক্রমাগত চক্কর
তুমি একবার আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতেই
আমি তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ি।
তুমি একবার আমাকে ছুঁয়ে দিলে
তখন আমি আর আমার থাকি না,
আগুনের উত্তাপে মোম যেমন গলে গলে উদ্বায়ী হয়
তোমার স্পর্শের ভেতর আমিও আমাকে হারিয়ে খুঁজি;
জন্মান্তরে আমি শুধু তোমার হয়ে যাই।
কবিতাঃ ১০
প্রহসন
রফিকুল নাজিম
‘ভাত দে কাপড় দে
নাইলে গদি ছাইড়া দে’
মিছিলে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় শহরের প্রধান সড়ক,
অলিগলি, সংসদ ভবন, এভিনিউ, পার্টি অফিস
মিছিল দিলে ভুখাদের একবেলা ডাল ভাতের জোগাড় হয়।
ভুখা মানুষগুলো গলা ফাটিয়ে মিছিল করে
টিয়ার শেল খায়, লাঠির পেঁদানি খায়
পুলিশ ও গদিওয়ালা বাহিনীর লাত্থি উষ্ঠা খায়
মাঝে মাঝে বুলেটও খায়; রক্ত ঝরে এবং মরে।
ভুখাদের রেট নেহাত কম নয়
ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশ থেকে একশো টাকা
নানান ক্যাটাগরি আছে
লাইনের বিষয় আছে
গলা ও স্লোগান আরো গুরুত্বপূর্ণ…
শহুরে বস্তির জুলমত স্লোগান ধরে
সমস্বরে আকাশ ভাঙে টোকাই দল ও উদ্বাস্তু শহরবাসী।
একদিন গদির পরিবর্তন হয়
শুধু ভুখা মানুষগুলোর রেট আর বাড়ে না
গরম ভাতের প্লেটে ভরা থাকে রাজনৈতিক প্রহসন!
রফিকুল নাজিম
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
উপজেলা শিক্ষা অফিস
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।