Uncategorizedপ্রথম পাতাপ্রবন্ধসর্বশেষ

ঈশ্বরের দয়া নির্দয়তা  এবং  রবীন্দ্রনাথ

 

মিরাজুল হক

বিষয়টা পুরাতন । তবুও তা নতুন , আমার  মতো অনেকেরই কাছে । মানুষের  জীবন একটি  মহাজাগতিক ভ্রমণ ; তার  গতিপ্রকৃতি চলে আঁকা বাঁকা পথে । কেননা  চলার ধরন বহুমাত্রিক । হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঘরের চৌকাঠ টপকে পাড়া গ্রাম সমাজ  দেশ অতিক্রম করে  যে মানবশিশুর সংগে বিশ্ব প্রকৃতির  পরিচয় ঘটে , সেই সব শিশুর জীবনের তাল লয় ছন্দ একই  রকম হয় না । বিভিন্ন শিশুর মনের আধার হরেকরকম , আলাদা ।   নানান প্রশ্ন জাগে ।  তার প্রধান কারন হল আমদের ‘ মন ‘ । বুদ্ধি চেতনা বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ  হল এই ‘ মন ‘ , যা চিন্তা অনুভূতি , আবেগ ও ইচ্ছার মাধ্যমে প্রকাশিত । মানুষকে ছককাটা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যতটা কঠিন , হৃদয় দিয়ে বোঝা ততটাই  সহজ ।  

 

রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র সিদ্ধার্থ রাজপ্রসাদ থেকে বেরিয়ে ,  দেখতে পান  একজন বৃদ্ধ মানুষ , একজন অসুস্থ মানুষ , একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে । প্রশ্ন জাগে রাজকুমারের মনে । সারথি ‘ ছন্ন ‘ কে জিজ্ঞেস করলে , সারথি বুঝিয়ে যা বলেন , তা হল – এই সব কিছু মানুষের নিয়তি । বৃদ্ধ , অসুস্থ ও পরে মানুষের মৃত্যু । আর সন্ন্যাসী এইসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে সংসার-জীবন ত্যাগ করে , মৃত্যুকে জয় করার জন্য বদ্ধপরিকর । তাই একরাতে ঘুমন্ত স্ত্রী পুত্রকে , পরিবারকে নিঃশব্দে বিদায় জানিয়ে রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন , রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ।

এই “ পথের শেষ কোথায় , শেষ কোথায় / কি আছে শেষে ? “ ( চণ্ডালিকা , রবীন্দ্রনাথ ) । এই পথই মানুষের চলার গতিপ্রকৃতি । উদ্দেশ্য বিহীন , ক্ষন বিলাসী এবং খাওয়া পরা বেঁচে থাকা , বংশবৃদ্ধির দৈনন্দিন কাজ কর্মের মধ্যে ভেসে যাওয়া জীবনের পথ নয় । জীবনের বাঁকে বাঁকে , বিশেষ করে পরিণত বয়সে  এ-প্রশ্ন মনে আসে বারাবার , অনেকবার  ।  

 

আমারা রক্তমাংসের মানুষ , সামান্য মানুষ , ছোট বড় নানান ভুল ভ্রান্তিতে ভরা  ।  তবুও ঈশ্বরের সৃষ্টিতে মানবসভ্যতার ইতিহাসের পাতা জুড়ে  এত জ্বালাযন্ত্রণা , এত অনাচার , অবিচার অত্যাচার কেন ? নাকি বিশ্ব-চরাচরে মঙ্গলবিধান সুপ্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা আছে ? তাই মাঝে মাঝেই ছন্দ পতন ঘটে , অশ্রুধারার বন্যা ছোটে ?  “ মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দন্দে  / ……  তোমার লীলাক্ষত্র মুখরিত কর অট্ট বিদ্রূপে ( পৃথিবী , রবীন্দ্রনাথ ) । “   

ক্যানসার রোগে হয়েছে যে  ছোট ছেলেটা  , যন্ত্রণায়  ছটপট করছে সে । দিশেহারা গরীব মা মন্দির , পীরের দরগা বা গির্জায় দিন রাত্রি মাথা খুঁড়লেও ঈশ্বরের কি করুনা মেলে ! করুনা হবে সেদিন , যেদিন ক্যানসার রোগের সঠিক ওষুধ ও চিকিৎসা পাবে ছেলেটি । ঈশ্বরের দয়া ও নির্দয়তা , দুটোই প্রকৃতির নিয়মে প্রকাশ পায় । এটা আমাদের বোঝানো হয় । কিন্তু মেনে নিতে পারি কি !

 

 বছর শতাব্দী ধরে যে অভাব বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে , ধর্মপ্রাণ  গরীব অর্ধ শিক্ষিত  নিম্নবিত্ত থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুমুসলমানদের এই দারিদ্র ও গ্লানির মোচন করার উপায় থাকে না বলে  ‘ স্বর্গ ‘ ও ’ বেহস্থের ‘  প্রলোভন দেখিয়ে , বোঝানো হয় এবং নিজেরা বুঝেও  যায় যে , ইহজীবনে যা কিছু ঘটে তা সহ্য করে যাও । ওপরওয়ালার বিধান যা , তা অনিবার্য । বিধাতার বিধান নিয়ে কি প্রশ্ন করা যাবে না ? রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রশ্ন করেছেন , “ যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু , নিভাইছে তব আলো / তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ , তুমি কি বেসেছ ভালো । “

বছর কয়েকের জন্য রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুটা সংকীর্ণ অর্থেই ‘ হিন্দু ‘ হয়ে উঠেছিলেন । এই হিন্দুত্বের , নাকি আর্যত্বের  সবচেয়ে উগ্র প্রকাশ বোধহয় ১৩০০ সালে লেখা প্রবন্ধ ‘ হিন্দুর ঐক্য ‘ ।  নব্য হিন্দু বা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি উৎসাহ দেখে , মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্রাহ্মসমাজের   সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেছিলেন যখন ,   রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেইশ – চব্বিশ । ত্রুন সম্পাদক নিষ্ঠার সংগে তা পালন করেছিলেন । কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারলেন যে ঈশ্বর  সাধনা এবং  ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতির নিয়মে  নিজেকে জড়িত করে , কাজে নিযুক্ত করা   তার পক্ষে অসম্ভব । এখানে মৌলিকতার  বড় অভাব ।  ধর্ম মানুষের সংগে মানুষের মিলন না-ঘটিয়ে বিচ্ছেদ ঘটায়  , যা তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কারন ।  “ আমি কেবল একটি মুখোশ পরে সত্যের জীবন্ত সরূপ ঢেকে রেখেছিলাম – বহুদিন ধরে এই চেতনার সংগে যুদ্ধ করে , অবশেষে আমার ধর্মসমাজের ( church ) সংগে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করলাম । “ ( The Religion of Man , Rabindranath Tagore ) । 

যদিও এই সময় রামমোহন রায় ও তাঁর অনুগামী দেবান্দ্রনাথ ঠাকুর ,   মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন পারসি – সবাইকে দূরে রেখে ,   কেবল হিন্দু একেশ্বরবাদীদের নিয়ে একটা বিশেষ ধর্ম সমাজ গড়ে তোলার কাজটি সম্পন্ন করলেন । ( পান্থ জনের সখা , আবু সইওএদ আইয়ুব ; পৃষ্ঠা – ১৩৬ )   । কিন্তু এই  প্রচেষ্টা সেই অর্থে  সফল হয়নি । কেননা রামমোহন  অবহত ছিলেন , কেমন করে পূর্বতন মহাপুরুষেরা – গৌতম বুদ্ধ , যীশু খ্রিস্ট  , হজরত মুহাম্মদ  ( ? ) – একটা সার্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যার্থ  হলেন । সেই ব্যার্থতার  পরিমাণ সরূপ গড়ে উঠলো কয়েকটি বিবাদমান সম্প্রদায় , ভেদাভেদের মানবগোষ্ঠী  । রামমোহন দেবন্দ্রনাথের  নির্দেশিত এই  পথ , কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পথ নয় । 

  

কবি , নাট্যকার , গীতিকার ও প্রবন্ধ লেখক নানান রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বেদনা ঠিক এক রকম ছাঁচে নয় , কখনোই না । এইসব ভিন্ন- ভিন্ন মাধ্যমের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পাই  । তাই শেষ পর্যন্ত কি ধারনা পেতে পারি !  হিসাবে প্রাপ্ত বিষয়টা কি ?   রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনা ও ঈশ্বরসাধনা অভিন্ন না -হলেও , পরস্পর অন্তরঙ্গ । “ নয় এ মধুর খেলা / তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল সন্ধ্যাবেলা /  নয় এ মধুর খেলা …  “ ( গীতবিতান )  ।  তাই তিনি  আমাদের বোঝাতে  চেয়েছেন যে , “ তোমার প্রমে আঘাত আছে , নাইকো অবহেলা “ ।

আশি বছর বয়সে বললেন , “ আমি পৃথিবীর কবি “ । তিনি  এই ভুবনের কবি , সুন্দর ভুবনের । “ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে / মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই । “  দর্শনের পরিভাষায় তাঁর নিজের জীবনের মূল্য , তাঁর কাছে সহজাত ও অপরিহার্য ( Intrinsic ) ছিল না ; ছিল পরাশ্রয়ী , বিশ্বাশ্রয়ী  । জগতের আলো এবং সে আলোয় যতদূর যা কিছু দেখা যায় সবকিছু তিনি অনুভবে আনমনে দেখতে চান । 

যেমনটা চেয়েছিল ক্ষীণ প্রানের ‘ অমল ‘ । ডাকঘরের প্রথম দৃশ্যে , আমাদের সবাইকে বেশ উৎসাহ নিয়ে আনান্দের সংগে অমল জানিয়ে দেয়  ,  “ আমি যা আছে সব দেখব , কেবলি দেখে বেড়াব । “ এই একটি বাক্যে প্রানভরা জীবন শক্তির বর্ণনা দিলেন রবীন্দ্রনাথ । অথচ মাঠে মাঠে , নদীর ধারে , গ্রামে গ্রামে , পাহাড়ে পাহাড়ে , পাহাড়ের ওপারে সবকিছু দেখে বেড়ানোর তো কথা নয় । কবিরাজ অমলকে বেরতে মানা করেছে । এই নাটকে কবিরাজকে  খানিকটা ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ; কবিরাজ ধর্মশাস্ত্র ও  সামাজিক বিধি নিয়মের প্রতীক । ফকির এসে , অমলকে বলে , ‘ তুমি ছোট হলে কি হবে , তুমিই রাজার প্রিয় বন্ধু ; রাজা তোমাকে পাহাড়ের গায়ে , নদীর জলে , রাস্তার আঁকা বাঁকা রেখায় , দইওয়ালার ডাকে , বালকদের খেলায় , বালিকাদের  তুলে-আনা ফুলের পাপড়িতে  লিখে পাঠিয়েছেন  কত শত সুন্দর চিঠি  , আর কত চিঠি পাঠাবেন । অমলের হৃদয় দুয়ার বন্ধ ছিল না কোনদিন ।  

অমল অনেককিছু চেয়েছিল ; সবচেয়ে নিবিড় ভাবে চেয়েছিল সুধা বাগান থকে ফুল তুলে বাড়ি ফেরার পথে তাকে  যেন একটা ফুল দিয়ে যাবে । সুধা ফুল নিয়ে এলো ঠিকই । তখন অমল নেই , চলেগেছে না- ফেরার দেশে । অমলের জীবনে যেমন , তার মৃত্যুতেও তেমনি একটি বিরাট রহস্যময় সৌন্দর্যের অনুভূতি ছড়িয়ে যায় বিশ্ব চরাচরে ; আমরাও তা অনুভব করি । ‘ ডাকঘর ‘  রবীন্দ্রনাথের  শোচনীয় আত্ম বিশ্লেষণ । তাঁর কল্পনা রোম্যান্টিক হলেও , তিনি সহজবোধ্য , পার্থিব । বৈরাগ্যসাধনে নয় , প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেই তাঁর মুক্তি , তাঁর ঈশ্বর ভাবনা । তাই অমলের শেষ পরিণতি  আমাদের বিষণ্ণ করলেও  দিশাহারা বোধ করি না , সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিদ্রোহে উত্তাল হয় না আমাদের মন । তাঁর সমসাময়িক  আইরিশ কবি Willium Bulter Yeats ( ১৮৬৫ – ১৯৩৯ ) , ডাকঘর সম্বন্ধে যা বলেছেন , তা-ই সত্য –  “ …… conveys to the right audience an atmosphere of gentleness and peace . “ 

 

রবীন্দ্রনাথের ‘ গীতাঞ্জলী ‘ নোবেল পুরস্কার পয়েছে , যা আমাদের অহংকার , গর্ব । আমারা জানি  প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস এড়িয়ে গেছেন  এই  ‘ গীতাঞ্জলী ‘ , নৈবেদ্য – এর পর থেকে । জীবনদেবতা , ঈশ্বরের দয়া নির্দয়তা ও মৃত্যু ভাবনার অনেক উত্তরণ ঘটেছে । তাই  প্রকৃতির প্রতিশোধ , বিসর্জন , ডাকঘর , সর্বোপরি শ্যামা নাটকে ‘ মৃত্যু ‘ ট্র্যাজেডির খুব পাশ দিয়ে , ঘেঁষে  চলে যায় । ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে না । তাই ঈশ্বরের সৃষ্টি আমাদের সৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে , আমাদের দৃষ্টিও । সেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরসখা , যিনি দুঃখের মৃত্যুর কবি হয়েও , আমাদের আনান্দের কবি , অমৃতের কবি । 

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে  পেতে হলে কি ইহলোক ছেড়ে পরলোকের দিকে ছুটতে হবে , সর্বশক্তি নিঃশেষ করে ?  বিধাতর ধর্মের নিয়ম রীতিনীতি নিয়ে সারাজীবনের এই  কি একমাত্র দিনলিপি । তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন ,   “ হাতের কাছে , কোলের কাছে / যা আছে সেই অনেক আছে , / আমার সারা দিনের এই কি রে কাজ / ওপার পানে কেঁদে চাওয়া । “  

যে বিশ্বাস সব ধর্মের সারকথা , তা হল আত্মার অমরত্ব । বেশীরভাগ মানুষের জীবন দুঃখে ভরা , বড় বেদনার জীবন কাহিনী  ; আবার অনেক অত্যাচারী অনাচারী মানুষ ভোগ বিলাসে সুখ স্বচ্ছন্দে থাকে । এই প্রেক্ষিতে পরকালে বিশ্বাস করা অনিবার্য হয়ে পড়ে । সেই পরকালে সবকিছুর হিসাব মেলানো হয় । কিন্তু গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরের প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছিলেন তাঁর ধর্ম শিক্ষায় । এই দিকটা কি করে অস্বীকার করা যায় ? 

অন্যদিকে খ্রিস্টানেরা মুসলমানেরা এক প্রচণ্ড শক্তিশালী অমঙ্গল বিলাসী “ শয়তান “ কে স্বীকার করে , সব অশুভ খারাপ কাজের পরামর্শদাতা স্বরূপ । শয়তানও ঈশ্বরের সৃষ্টি  , তবুও মানুষকে বিপথে নিয়ে গিয়ে  ঈশ্বরের সব শুভ উদ্দেশ্যকে তালগোল পাকিয়ে পণ্ড করে দেয় ।  এই ধরনের ভাবনার পরিকাঠামোতে রবীন্দ্রনাথের  ধর্মচিন্তার বিন্যাস নয় ।        

নূতন যুগের দিশারী রামমোহন রায়  ও  তাঁর অনুগামী মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম-ভাবনায় একটা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । সব ধর্ম মূলত এক এবং ধর্মের কাজ সম্প্রদায় গোষ্ঠীতে ভাগ করে মানুষে মানুষে বিবাদ সংঘর্ষ সৃষ্টি করা নয় । দুনিয়ার সব সম্প্রদায়ের মানুষকে , মানব জীবনের বৃহত্তর স্তরে মেলানো । তাঁদের এই প্রচেষ্টা সফল হয় নি । 

অবশেষে নানান দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়ে  নদনদী পাহাড় পর্বত পরিভ্রমণ করে রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা গিয়ে ঠেকলো সেই তরী থেকে তীরে , যার নাম দিয়েছেন “ মানুষের ধর্ম ( The Religion of Man ) “ । নামটা তাৎপর্যপূর্ণ ।  যা গোষ্ঠী সম্প্রদায় , জাতি বা দেশ-বিশেষের ধর্ম নয় । এইখানে রবীন্দ্রনাথ অবতীর্ণ হলেন সেই যুক্তি – তর্কে , যেটা রামমোহন রায়  এড়িয়ে গিয়েছেন । মনুষ্যত্বের চরম লক্ষ্য কি হতে পারে , তা নিয়ে যুগে যুগে জাতিতে জাতিতে এমন কি একই ধর্মের মানুষের মধ্যেও তফাৎ আছে । 

তাঁর ধর্ম-অনুভূতি ও ধর্মচিন্তা একটি বিশেষ রূপে প্রকাশিত হল ,  “ মানুষের ধর্ম ( The Religion of Man ) “ লেখায় । অক্সফোর্ডে হিবারট লেকচারে ঘোষণা করলেন , তাঁর বিষয় হল – “ Humanity of God “ । মানুষকে আলাদা করে , মানুষের বাহিরে ঈশ্বরের কথা তিনি বলেননি । তবে এ কোন মানুষ ? চোর ডাকাত খুনি অত্যাচারী তো  মানুষ নয় । আবার যে মহাপুরুষেরা বলেছেন , এদেরও ক্ষমা করে ভালবাসার কথা , রবীন্দ্রনাথ ফিরিয়ে দিয়েছেন বিনা নমস্কারে । 

মানুষ  না – জন্মালে  মনুষ্যত্বের আদর্শ বা পূর্ণপুরুষ  বলে কিছু থাকতো না । মানুষ না-থাকলেও চন্দ্র সূর্য থাকতো , মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে তাদের গতিপথ নির্ধারিত হত । খ্রিস্টান বা মুসলমান ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবী বা মানুষ সৃষ্টি না-হলেও , ঈশ্বরের পূর্ণতার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না । তাই মানুষের ধর্মে রবীন্দ্রনাথ যে ঈশ্বর-ভাবনার কথা বলেছেন , সে ঈশ্বর মানুষেরই হৃদয়ে আসীন – মানুষের হৃদয়ের ভাবনায় , কর্মকাণ্ডে , কর্ম উদ্যোগে যা  প্রকাশিত  , তাই সত্য । মানুষ নিরপেক্ষ যা কিছু বলা হয়েছে , আদেশ উপদেশ দেওয়া হয়েছে ,  তা সত্য নয় ।  বিশ্ব জুড়ে প্রাকৃতিক বিধানের  ( Law of Nature )  একজন আদি সৃষ্টিকর্তা থাকলেও , মানব- সমাজের মঙ্গল বিধান মানুষকেই রচনা করতে হবে । তিনি জিজ্ঞেস করেছেন  “ ভজন পুজন সাধন আরাধনা / সমস্ত থাক পড়ে । রুদ্ধদ্বারে  দেবালয়ের কোণে / কেন আছিস ওরে । “ 

মানব- সমাজের  এই মঙ্গল বিধান একটি পরিপূর্ণতার আদর্শ বিষয়ে মানুষের বোধ বা সচেতনতা স্থিতিশীল নয় । তা যুগ যুগ ধরে বদলেছে , ক্রমশ উন্নততর হয়েছে । এই ধর্মভাবনায় একটা বাধ্যকতাবোধ থাকে । শুভ কাজের বাধ্যকতা যেমন ।  এটা বাজারের কেনাকটার পণ্য নয় । অবশ্য সচেতনতার ভুল ভ্রান্তি হতে পারে । তা মন গড়া যুক্তি নির্ভর নয় । বিজ্ঞানও তো যুগে যুগে ভুল করে এবং ভুল শোধরায় । তা বলে বৈজ্ঞানিক সত্য মন গড়া গল্প হয় না । তেমনি কর্মের সত্য খেয়াল খুশির ব্যাপার নয় । 

 

এই মানব সমাজ ও পৃথিবীকে যে ভাবে দেখব  , ঠিক সেই ভাবে আমাদের মনে  প্রকাশিত হবে এই বিপুল পৃথিবী ও মনুষ্য সমাজ । একটি মৃতদেহ শকুনের কাছে নিয়ে আসে খাবারের নিশ্চয়তা । আবার একজন সহৃদয় ব্যাক্তির কাছে নিয়ে আসে শোক , পরিবারের বুকে নিয়ে আসে স্তব্ধতা , হত্যাকারীর কাছে নিয়ে আসে উল্লাস । তাই জগতকে আমারা যেভাবে দেখব , জগত ঠিক সে রকম ভাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত হবে  । তাই তো রবীন্দ্রনাথের ঋষি -বানী – 

“ আমারই চেতনার রঙে পান্না হল

                  সবুজ ,

         চুনি উঠলো রাঙা হয়ে ।

আমি চোখ মেললুম আকাশে , জ্বলে 

          উঠলো আলো ,

        পুবে – পশ্চিমে ।

গোলাপের দিকে তাকিয়ে বললুম 

           সুন্দর , 

       সুন্দর হল সে । “ 

 

আত্ম উপলব্ধি বহুমাত্রিক এবং নিজস্বতা নির্ভর দৃষ্টি ভঙ্গী , দৃষ্টি কোন  । যা  মনের শ্রেষ্ঠ দরজাটিকে খুলে দেবে । পান্নাকে সবুজ , গোলাপকে সুন্দর বলবে । শান্ত বা দিকভ্রান্ত সহযাত্রী কেও আপন করে নিতে শেখাবে । চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটবে । এই ভাবেই  আমাদের সুস্থ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ।  ‘ সুখ দুঃখ আনান্দ বেদনা ভয় বিহ্বলতা ‘র  সঙ্গী । অবসরে , আনামনে । সব সময়ে ।

 

 মানুষের সত্তায় দুটি বিপরীত ভাবনা আছে । একদিকে সে সৃষ্টিকর্তার দিকে ঝুঁকে থাকে ; অন্যদিকে সমস্ত পার্থিব নিয়মের জালে জড়িয়ে । তবে পরম মানবিক সত্তা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ,  “ হৃদয়ে  হৃদয়ে তাঁর পীঠস্থান …… এই মনের মানুষ , এই সর্বমানুষের জীবনদেবতার কথা বলার চেষ্টা করেছি ‘ Religion of Man ‘ । 

তবে মানুষের আত্মা অমর , শারীরিক মৃত্যুতে তার ক্ষয় নেই  — এর উত্তর তিনি  দিচ্ছেন না । এ-পারের আলোছায়ার বিচিত্র  গান তো অনেক গেয়েছেন ; দিনান্তের বেলায় তাই ভাবতে লাগলেন – “ এ-পারের কৃষি হল সারা / যাব ও-পারের ঘাটে “ । এটা কি অনিচ্ছাকৃত  ললাট লিখন ।  জীবনের ধারাবাহিক পরম্পরা । তাই তাঁর জীবনের সব সঞ্চয় নিয়ে তীরে এসে দাঁড়ালেন , “ যা কিছু মোর সঞ্চিত ধন / এতদিনের সব আয়োজন / চরম দিনে সাজিয়ে দিব উহারে — / মরন যেদিন আসবে আমার দুয়ারে । “ এই সঞ্চিত ধন রাশি কি ? এটা কি কেবল ধর্মীয় রীতি নিয়মে উপাসনার ধনরাশি ! 

হাওড়া,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।    

.

.

.

 

তথ্য সুত্র ঃ 

১। গীতবিতান , সঞ্চয়িতা , ডাকঘর , শ্যামা – রবীন্দ্রনাথ ।

২। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ , পান্থ জনের সখা  – আবু সৈয়দ আইয়ুব   ।

৩। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিস্কার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়   । 

৪। Towards Universal Man by Rabindranath Tagore . Asia Publishing ; Edited by Humayun Kabir , 1961 

 

[প্রকাশিত প্রবন্ধটির দায়ভার লেখকের ]

 

        

     

 

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]