পার্থসারথি
রুচিরার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আরও পনের বিশ দিন লাগবে শেষ হতে। সৈকতের পরীক্ষা সামনের সপ্তাহেই শেষ হবে। আর আজই পারমিতার শেষ পরীক্ষা। রুচিরা ও সৈকতের আজ পরীক্ষা নেই। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে ওরা পারমিতার অপেক্ষায় আছে। পারমিতার প্রতিটি পরীক্ষায় ওরা থেকেছে। পরীক্ষা শেষে কিছুক্ষণ গল্প পরপর কয়েক কাপ চা। তারপর পারমিতাকে রিকশায় তুলে দিয়েছে।
পারমিতা কমন রুমের দরজা দিয়ে বের হল। পারমিতাকে দেখতে পেয়েই সৈকত এগিয়ে গেল রুচিরাকে নিয়ে। রুচিরা পারমিতাকে এক হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। আর পাশাপাশি সৈকত। আর্টস বিল্ডিংয়ের মেইন গেইটের সিঁড়িতে ওরা তিনজন বসল। পিচ্চিটাকে ডাকতেই তিন কাপ চা দিয়ে গেল। সৈকত চা শেষে সিগারেট ধরায়। পারমিতা আড়চোখে তাকাতেই সৈকত হাত জোড় করে বলে প্লিজ, রাগ করো না। ধীরে ধীরে ছেড়ে দেব। হঠাৎ ছাড়তে অসুবিধা হচ্ছে।
পলকহীন দৃষ্টিতে পারমিতা তাকায়, তারপর বলে- ধীরে ধীরে বলতে আবার বছর লাগিওনা যেন।
ঠিক আছে মহারাণী সময় নেব না।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে পারমিতা রুচিরাকে বলে ‘রুচিদি, কিছু মনে করো না। আজ একটু তাড়া আছে। বাড়ি থেকে বাবা আসবেন। আমি এখন উঠতে চাই।
চায়ের কাপটা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে রুচিরা বলে- তাড়া থাকলে অবশ্যই যাবে। এখন ক’টা দিন একটু বিশ্রাম নাও।
পারমিতা উঠে দাঁড়ায়। সৈকত রাতে ফোন করো কিন্তু।- এই বলে আড়াচোখে তাকায় সৈকতের আশ্চর্য ভরা চোখে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি নিজে ফোন করব? সৈকতের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। পারমিতা হাসি ছড়িয়ে বলল হ্যাঁ, তুমি নিজে ফোন করবে।
সৈকত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে- আমি ! কী ব্যাপার?
কোন ব্যাপার নয়। আজ বাবা আসবেন।
তাই বল। তোমার বাবার সাথে অবশ্য আমার ভালই জমে। ঠিক আছে ফোন করব। এই বলে সৈকত দু’কদম পিছিয়ে বলে পারমিতা, বাবাকে আমার প্রণাম জানিও।
পারমিতার সাথে সাথে রুচিরাও হাসে। হাসি থামিয়ে পারমিতা বলে ঠিক আছে প্রণাম জানাব। তাড়াতাড়ি একটা রিকশা করে দাও প্লিজ।
রিকশায় বসে পারমিতা হাত নাড়িয়ে বিদায় নেয়।
রুচিরা ও সৈকত লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায়। রিকশাটা বাসার কাছে পৌঁছতেই পারমিতার চোখ জোড়া বারান্দায় পৌঁছে যায়। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বারান্দায় উঠেই বাবাকে প্রণাম করল পারমিতা। ঋতেশ বাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন পরীক্ষা কেমন দিলে মা?
ভালো দিয়েছি। তোমার শরীরটা ভালো আছে তো?
হ্যাঁ মা। এই শেষ বয়সেও বেশ ভালো আছি।
পারমিতা আর কথা বাড়ায় না। পারমিতা বুঝতে পেরেছে এই এখনই দিদির প্রসঙ্গে চলে আসবে। তারপর কান্নাকাটি করে অসুখটা বাড়াবে।
রুমে এসেই পারমিতা শরীরটাকে বিছানায় ঢেলে দিল। একটা বালিশ টেনে মুখ গুজে দিল। দিদিকে খুব বেশি মনে পড়ছে ক’টা দিন ধরে। দিদি মারা গেছেন আজ প্রায় আড়াই মাস হতে চলল। পারমিতা পরীক্ষা দিতে চায় নি। পরীক্ষার ব্যস্ততায় যদি আবার দিদির রেখে যাওয়া সন্তান তৃষ্ণার অযত্ন হয় এই ভয়ে। কিন্তু অভীক মজুমদারের বক্তব্য- পৃথিবীতে কোন কিছুই থেমে থাকে না। আপন গতিতে সবকিছুই চলে। কেন মিছিমিছি একটা বছর নষ্ট করবে। তাছাড়া তোমার মা তো আছেনই। তুমি তোমার পরীক্ষা ঠিকমত দাও। তারপর অন্য চিন্তা করো।
পাশে কেউ বসেছে পারমিতা টের পেল। কিন্তু দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায়নি। কিছুক্ষণ নীরবতা। পারমিতার মাথায় হাত রেখে প্রভাময়ী দেবী বলেন কি রে মা, এই অসময়ে শুয়ে আছিস? হাত-মুখ ধুয়ে কিছু একটা মুখে দিয়ে নে।
পরমিতা শুয়ে শুয়ে বলে- একটু পরে উঠছি মা।
প্রভাময়ী দেবী পারমিতার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। পারমিতা বুঝতে পেরেছে যে- মা নিশ্চয়ই কিছু বলবেন। মা সবসময় যেমন আদর করেন তেমনি আবার কিছু কিছু ব্যাপারে বেশ কঠিন। আবার যখন কোন উপলক্ষ্য ছাড়া আদর করেন, তার মানে কোন উদ্দেশ্য মনের ভেতর আছে।
পারমিতা চুপচাপ শুয়ে আছে। প্রভাময়ী দেবী পারমিতার কপালে হাত রাখেন। তারপর বলেন মা উঠ, আগে মুখে কিছু একটা দিয়ে নে। তারপর আবার শুয়ে থাকিস।
পারমিতা উঠে বসে। তারপর মার দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টি নিয়ে। পারমিতাকে আরেকটু আদর করে প্রভাময়ী দেবী রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
পারমিতা বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। বেসিনে গিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটায়। তারপর মুখে তোয়ালে বুলাতে বুলাতে ড্রেসিং টেবিলে গিয়ে চুলটা ঠিক করে যায় ডাইনিং টেবিলে। প্রভাময়ী দেবী নিজ হাতে মেয়েকে খাওয়ালেন। খাওয়ানোর এক ফাঁকে মা বললেন পারমিতা তোর বাবাকে আমিই খবর দিয়ে আনিয়েছি।
এক বাক্যে উত্তর দিল পারমিতা- খুব ভালো হয়েছে।
এনেছি একটা কাজে।- মা প্রভাময়ী দেবী বললেন।
কী কাজে?- এই বলে পারমতিা মায়ের দিকে তাকায়।
মা একটু ভেবে বলেন তুই খেয়ে তোর রুমে যা। তোর বাবাকে নিয়ে একটু পরে আমি আসব। তখনই সব বলব।
পারমিতা মাথা নাড়ে- আচ্ছা, ঠিক আছে মা।
রুমে এসে পারমিতা চুপচাপ শুয়ে থাকে। কপালের উপর দুটো হাত আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, বেশ চিন্তা-ভাবনায় ডুবে আছে। সত্যি বলতে কী দিদির মৃত্যুটা দারুণভাবে নাড়া দিয়ে গেছে পারমিতাকে। দিদির মৃত্যাটাকে সে সহজে মেনে নিতে পারছে না। তার ওপর মেয়ে তৃষ্ণাটা কেমন অসহায় হয়ে গেল। দিদি ছিল একজন চমৎকার পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যার ভেতর ছিল আকাশের মত স্বচ্ছ আর নির্মল। আকাশের অসীমতাও ছিল দিদির সারা বুক জুড়ে।
ভালোবাসতে পারতো সবাইকে। ভালোবাসার মাঝে কোন রকম কৃপণতা ছিল না।
রুমে ঢুকেই ঋতেশ বাবু গলা খাকাড়ি দেন। পারমিতার চিন্তার জগতে যতি পড়ে। উঠে বসতে বসতে পারমিতা বলে বাবা, এস বসো।
বাবা বসতে বসতে মা-ও চলে এলেন।
বাবা কী কথা দিয়ে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।মায়ের দিকে একবার তাকালেন। মা চোখ নেড়ে ইশারা করলেন কথা শুরু করার জন্য। বাবা তবুও কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে তারপর শুরু করলেন- মা পারমিতা, তৃষ্ণা মনি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে। ওকে একটু নিজের মত করে মানুষ করিস।
পারমিতা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে বাবা, আমি কি তৃষ্ণার প্রতি কোনরকম অযত্ন করেছি?
না মা, সে কথা নয়। তুই ছাড়া তৃষ্ণা মনিকে আর কে দেখবে? আমরাতো আর সবসময় থাকতে পারবো না?
ঠিক আছে বাবা, তোমরা এ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করো না। আমি যতটুকু পারি করবো। আমার অজান্তে কোন অযত্ন আমি করবো না।- পারমিতাকে মা-বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করে।
সে কথা তোকে বলতে হবে না। ঋতেশ বাবু একটু আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করেন আমরা একটু অন্যরকম চিন্তা ভাবনা করছি।
পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে- তোমরা কী ধরনের ভেবেছ জানতে পারি কি?
মা, তুই আমাদের ভুল বুঝিস না। তোর অমঙ্গল হবে এমন চিন্তা-ভাবনা কখনও করিনি। তাছাড়া অভীক চমৎকার ছেলে। তোর দিদির স্মৃতিকে আগলে রাখ মা। এই আমাদের অনুরোধ।
পারমিতা নির্বাক । এ রকম চিন্তা ভাবনা মা বাবা করবেন তা পারমিতার মনের ভেতর কোনদিন আসে নি। আসার কথাও না। কারণ পারমিতার হৃদয়-জগৎ জুড়ে একজনের নিত্য আনাগোনা। মনের পুরো বাগানটি জুড়েই সৈকতের একাধিপত্য। সৈকত ছাড়া অন্য কারও কথা মনের ভেতর কখনও ঠাঁই দেয় নি পারমিতা। পারমিতার ইচ্ছে ছিল রাতে যখন সৈকত ফোন করবে তখন বাবাকে ব্যাপারটি বলবে এবং প্রয়োজনে বোঝানোর চেষ্টা করনে। চিন্তার জগত পেরিয়ে এসে পারমিতা অতি কষ্টে উচ্চারণ করে- বাবা !
বল মা।- এই বলে ঋতেশ বাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘বাবা, তোমরা অন্য চিন্তা করোর প্লিজ।- এই বলে পারমিতা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মা প্রভাময়ী দেবী পারমিতাকে কোলে টেনে নেন। স্নেহের হাত মাথায় বুলাচ্ছেন। বাবা, ঋতেশ বাবু ধরা গলায় বলেন- কাঁদিস না মা, তোকে আমরা জোর করব না। তুই চিন্তা-ভাবনা কর। তুই এখন বড় হয়েছিস। তোর মতামত অবশ্যই থাকবে। তবে এটুকু জেনে রাখিস, তোর অমঙ্গল হবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা অভীক যদি অন্য কোন মেয়েকে তুলে আনে তাহলে তৃষ্ণার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। তৃষ্ণাকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। তৃষ্ণা কষ্ট পেলে তোর দিদির আত্না শান্তি পাবে না।
কথাগুলো কানে পোঁছামাত্রই দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো পারমিতার কানে ষ্পষ্ট হয়ে বেজে ওঠে।
মা, না করিস না। অভীককে অনেক বুঝিয়ে তবে রাজী করিয়েছি। এখন তুই না করলে ও ভীষণ কষ্ট পাবে। তাছাড়া আমাদের ভাববে কী?- মা প্রভাময়ী দেবী খুব শান্ত গলায় বললেন।
মা এবং বাবা যেভাবে কথা বলেছেন পারমিতা রাগ করার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। অবশ্য পারমিতা কাছে আসার আগে ঋতেশ বাবু প্রভাময়ী দেবীকে বারবার বারণ করে এসেছেন কোনমতেই যেন তিনি পারমিতার সাথে রাগারাগি না করেন। এখানেই পারমিতার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারমিতা উভয় সংকটে আছে। যদি বাবা কিংবা মা রাগ করে বলতেন তবে একটা কিছু সরাসরি কঠোরভাবে বলা যেত। পারমিতা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে।
মা এই শেষ বয়সে তোদের সুখী দেখে যেতে চাই। মা-বাবা ছেলে-মেয়েদের অমঙ্গল কখনও চিন্তা করে না। তাছাড়া তোর ওপর আমার সবসময় আস্থা ছিল এবং এখনও আছে।- এই বলে ঋতেশ বাবু চুপচাপ তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।
পারমিতা চুপচাপ , নিঃশ্বাসও যেন থেমে আছে। দৃষ্টি সরিয়ে অভিমানভরা মন নিয়ে তাকিতে আছে অন্যদিকে।
ঋতেশ বাবু পারমিতার হাত ধরে বলেন- মা, তুই অমত করিস না। তাহলে আমরা শান্তিতে মরতে পারব না। ঋতেশ বাবুর কণ্ঠস্বরটা কেমন বেসুরা মনে হচ্ছে। পারমিতা তাকায়, বাবার চোখে জল। পারমিতার ভেতরটা কষ্টের ঝড়ে হু, হু করে ওঠে।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা বলে বাবা, আমাকে একটু সময় দাও ।
ঋতেশ বাবু ইশারা করতেই প্রভাময়ী দেবী উঠে চলে গেলেন।
শান্ত হও মা, শান্ত হও!- ঋতেশ বাবু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন ।
বাবার বুকে কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে পড়ে রইল পারমিতা। তারপর পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। মাকে দেখতে না পেয়ে একটু সাহস পায় এবং বলে বাবা, আমার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে। আমি ওর কাছে কী জবাব দেব?
ঋতেশ বাবু মর্মার্থটা প্রথমে বুঝতে পারে নি। অবশ্য পরক্ষণই মুখমগুলটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মেয়ে বলে কি! কপালে চিন্তার রেখা বলি হয়। পারমিতা ব্যাপাটা বুঝতে পারে। ঋতেশ বাবু হতাশাগ্রস্ত এবং শংকায় কাবু হয়ে বসে আছেন।
পারমিতা বলে বাবা, সৈকত আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে। আমিও।
ঋতেশ বাবু চিন্তাচ্ছন্ন অবস্থায় পারমিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। মেয়ের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছেন না। এই মূহূূর্তে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছনে না। খুব কষ্ট করে শেষে উচ্চারণ করলেন- মা এই বয়সে এমন ঘটনা সবার জীবনেই থাকে। তোর ভালোবাসাকে কিংবা ভালোবাসার জনকে উপেক্ষা করছি না। তবে ভালোবাসা কি শুধু মিলনেই সার্থক হয় ?
আশ্চর্য-ভরা দৃষ্টিতে পারমিতা বাবার দিকে তাকায়। বাবার দৃষ্টি কাছে নেই, সুদূরে মেলে ধরছেন। পারমিতার দিকে না তাকিয়েই তিনি বলেন ‘বিচ্ছেদের মধ্যেও ভালোবাসার সার্থকতা থাকে। তখন ভালোবাসার জনকে চিরদিন বুকে লালন করা যায়। তাছাড়া বর্তমান টানাপড়েনটা মানবিক টানাপড়েন। এক্ষেত্রে মানুষকে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। তোকে আমি কখনও কিছুই বলি নি, এখনও কিছু বলতাম না।
পারমিতা কথা বলার মত কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে শুধু বলল সৈকত ভীষণ কষ্ট পাবে বাবা। ওর যদি কিছু হয় তাহলে তার জন্য আমি দায়ী থাকব।
ঋতেশ বাবু এবার যেন সুযোগ পেয়ে গেলেন, বললেন- তোকে যদি সত্যি সত্যি ভালোবেসেই থাকে তাহলে তোর অবস্থা বোঝা উচিত। তাছাড়া যাদের মাঝে ভালোবাসা আছে তারা ত্যাগেও প্রস্তত থাকে।
দু’জন চুপচাপ। পিনপতন নীরবতায় শুধু দেয়াল ঘড়িটা টিকটিক তালে বেজে চলছে। তারপর ঋতেশ বাবুই শুরু করলেন এটা শুধু সময়ের ব্যাপার, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মা, তুই বড় হয়েছিস। তবুও তোর কাছে চাওয়ার আছে আমাদের । তুই ফিরিয়ে দিস না মা।
বাবার আকুল আরজিতে পারমিতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। আবার মুহুর্তে মুহূর্তে সৈকতের ছায়ামূর্তি এসে হানা দিচ্ছে। বুকের ভেতর কষ্টের কুয়াশা জমাট বাঁধছে ক্রমশ। পারমিতা নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। ঋতেশ বাবু ভাবলেন এই মূহূর্তে কথা বলা আর ঠিক হবে না। মনটা দুর্বল হয়ে এসেছে। একটু কাঁদতে দেয়া উচিত। কাঁদুক বুকটা হালকা হবে । ঋতেশ বাবু শব্দগহীনভাবে উঠে চলে এলেন।
পারমিতার সারাটা রাত কেটেছে এক দ্বন্দ্বমুখর আন্তর্ঘাতে। ভাবনার সীমানায় সৈকতকে নিয়ে একটি নিজস্ব জগতের স্বপ্ন যখনই আঁকে তখন দিদির আকুতি মাখা মুখ অসহায় তৃষ্ণার নির্মল চাহনি, অভীক মজুমদারের ছিন্নভিন্ন মূহূর্তের প্রতিচ্চবি আর মা-বাবার আকুল আর্তি এসে পারমিতাকে হানা দেয়। পারমিতা ঠিক থাকতে পারে না। এক সময় বাধ্য হয়েই পারমিতা সৈকতের প্রতিচ্ছবি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর মনে মনে দুঃখী উচ্চারণ আমাকে ভুল বুঝো না সৈকত ! তুমি সুখে থেকো, তুমি সুখে থেকো গো!- এর বেশি কিছু আর ভাবতে পারে না পারমিতা।